সব চেষ্টার পরেও কেন এই শুষ্ক ত্বক?
শীত হোক বা গরম, আমাদের দেশের মায়েদের একটা কমন দুশ্চিন্তা হলো বাচ্চার ত্বকের যত্ন। আপনি হয়তো পৃথিবীর সেরা লোশনটা কিনে এনেছেন, দামী অলিভ অয়েল মাখছেন, নিয়ম করে গোসল করাচ্ছেন—তবুও দেখছেন আপনার আদরের সোনামণির ত্বক খসখসে হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে লাল লাল র্যাশ উঠছে, বাচ্চা চুলকাচ্ছে আর কান্না করছে। ডাক্তার দেখালেন, অয়েন্টমেন্ট দিলেন, কয়েকদিন ভালো থাকলো, আবার যেই-কে-সেই!
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, সমস্যাটা হয়তো বাচ্চার শরীরে নয়, সমস্যাটা তার গায়ে জড়ানো কাপড়টিতে? হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। আমরা মায়েরা বাচ্চার খাবার আর স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট নিয়ে যতটা খুঁতখুঁতে, বাচ্চার কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট বা সাবান নিয়ে ততটাই উদাসীন। আমরা অনেকেই মনে করি, "কাপড় পরিষ্কার হলেই হলো, আর সুন্দর গন্ধ থাকলেই হলো।" কিন্তু এই 'সুন্দর গন্ধ' আর 'ঝকঝকে সাদা' করার কেমিক্যালই যে আপনার বাচ্চার ত্বকের বারোটা বাজাচ্ছে, তা হয়তো আপনি অজান্তেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা একদম খোলামেলা আলোচনা করব—কেন ডিটারজেন্ট শিশুর ত্বকের শত্রু হতে পারে এবং একজন সচেতন মা হিসেবে আপনার কী করণীয়।
শিশুর ত্বক: বড়দের চেয়ে কতটা আলাদা?
প্রথমে একটু সায়েন্সটা সহজ ভাষায় বুঝি। আমাদের অর্থাৎ বড়দের ত্বকের ওপরের স্তরটা বেশ শক্তপোক্ত, যাকে বলা হয় 'স্কিন ব্যারিয়ার'। কিন্তু নবজাতক বা ছোট শিশুদের ত্বক বড়দের তুলনায় প্রায় ৩০% পাতলা। এই বয়সে তাদের ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি তৈরি হয় না।
এর মানে হলো, আপনি যখন বাচ্চার কাপড়ে কড়া ডিটারজেন্ট ব্যবহার করেন, তখন সেই কাপড়ের সুতোর ফাঁকে ফাঁকে ডিটারজেন্টের অতি-ক্ষুদ্র কণা আটকে থাকে। বাচ্চার পাতলা ত্বক সেই কেমিক্যালগুলো স্পঞ্জের মতো শুষে নেয়। বড়দের ত্বকে যেটা হয়তো সামান্য একটু চুলকানি তৈরি করবে, বাচ্চার ত্বকে সেটা একজিমা (Eczema) বা কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসের মতো মারাত্মক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ডিটারজেন্ট ডার্মাটাইটিস: সমস্যাটা আসলে কোথায়?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা সাধারণত কাপড় ধোয়ার জন্য কড়া ক্ষারযুক্ত গুঁড়া সাবান বা 'বার সোপ' ব্যবহার করি। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখি—এক ঘষাতেই সব দাগ সাফ! কিন্তু এই পরিষ্কার করার প্রক্রিয়ায় কী কী ব্যবহার করা হয়, তা কি জানেন?
১. সারফ্যাক্ট্যান্ট (Surfactants): এটি ময়লা দূর করে ঠিকই, কিন্তু এটি কাপড়ের ফাইবার থেকে সহজে যেতে চায় না। এটি বাচ্চার ত্বকের প্রাকৃতিক তেল (Natural Oil) শুষে নেয়, ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে ফেটে যায়।
২. সুগন্ধি (Fragrance): বাচ্চার গা থেকে ফুলের গন্ধ আসবে—এটা ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু সিন্থেটিক সুগন্ধি বাচ্চার শ্বাসকষ্ট আর অ্যালার্জির অন্যতম প্রধান কারণ।
৩. অপটিক্যাল ব্রাইটেনার (Optical Brighteners): সাদা কাপড়কে নীলচে-সাদা বা উজ্জ্বল দেখানোর জন্য এই কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এটি কাপড়ের ওপর একটি আস্তরণ ফেলে রাখে, যা বাচ্চার ত্বকে সারাক্ষণ ঘষা খেতে থাকে।
৪. এনজাইম (Enzymes): দাগ তোলার জন্য ডিটারজেন্টে এনজাইম থাকে। এটি মূলত প্রোটিন ভেঙে ফেলে। বাচ্চার ত্বকের কোষও কিন্তু প্রোটিন দিয়ে তৈরি। বুঝতেই পারছেন, এটা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে?
কীভাবে বুঝবেন ডিটারজেন্টই দায়ী?
অনেক সময় আমরা বুঝতেই পারি না যে র্যাশটা আসলে কেন হচ্ছে। খাবারের অ্যালার্জি নাকি ডায়াপার র্যাশ? ডিটারজেন্ট অ্যালার্জির কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে:
জায়গাগুলো খেয়াল করুন: র্যাশ বা শুষ্কভাব কি সেসব জায়গায় বেশি যেখানে কাপড় শরীরের সাথে একদম লেগে থাকে? যেমন—বগলের নিচে, পিঠে, পেটে (যেখানে প্যান্টের রাবার থাকে), বা গলার ভাঁজে? যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তবে ডিটারজেন্টের দোষ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ডায়াপার এরিয়া: আপনি হয়তো ভাবছেন ডায়াপার র্যাশ, কিন্তু খেয়াল করুন কাপড়ের ডায়াপার বা প্যান্টের ইলাস্টিকের নিচে র্যাশ হচ্ছে কি না।
ঋতু বদল ছাড়াই সমস্যা: আবহাওয়া ভালো, কিন্তু বাচ্চার ত্বক খসখসে। লোশন দিলেও কাজ হচ্ছে না।
বিছানায় শোয়ালে কান্না: বাচ্চার বিছানার চাদর বা বালিশের কভারও যদি একই কড়া ডিটারজেন্টে ধোয়া হয়, তবে বাচ্চা বিছানায় শোয়া মাত্রই অস্বস্তি বোধ করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আমাদের ভুলগুলো কোথায়?
আমাদের দেশের মায়েদের বা কাজের খালাদের কাপড় ধোয়ার কিছু অভ্যাস বাচ্চার ত্বকের ক্ষতি ত্বরান্বিত করে।
ভুল ১: অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট ব্যবহার
আমাদের একটা ধারণা আছে, "ফেনা যত বেশি, পরিষ্কার তত বেশি।" তাই আমরা বালতিতে মুঠো মুঠো পাউডার ঢেলে দেই। কিন্তু ওয়াশিং মেশিন বা হাতের ধোয়ায়—অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট কখনোই পুরোপুরি ধুয়ে যায় না। এই অবশিষ্ট সাবান বা 'রেসিডু' শুকিয়ে কাপড়ে সাদা ছোপের মতো লেগে থাকে, যা বাচ্চার ত্বকের জন্য বিষের মতো।
ভুল ২: পানির সমস্যা (Hard Water)
ঢাকা বা বড় শহরগুলোর পানিতে প্রচুর আয়রন বা খনিজ থাকে (যাকে আমরা 'হার্ড ওয়াটার' বলি)। হার্ড ওয়াটারে সাবান সহজে ফেনা হয় না, আবার সহজে যেতেও চায় না। ডিটারজেন্টের মিনারেলগুলো কাপড়ের আঁশে আটকে থাকে, যা পরে বাচ্চার ত্বককে ইরিটেট করে।
ভুল ৩: অ্যান্টিসেপটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার
করোনার পর থেকে আমরা অনেকেই বাচ্চার সব কাপড় ডেটল বা স্যাভলন পানিতে চুবিয়ে রাখি। মনে রাখবেন, এগুলোও কেমিক্যাল। অতিরিক্ত অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার বাচ্চার ত্বকের ভালো ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে এবং ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্ক করে দেয়।
সমাধান: কী করবেন, আর কী করবেন না
আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন আনলেই আপনি আপনার সোনামণির ত্বককে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবেন।
১. বেবি-সেফ ডিটারজেন্ট বা লিকুইড ব্যবহার করুন
বড়দের ডিটারজেন্ট বাচ্চার জন্য ব্যবহার করবেন না। বাজারে এখন অনেক 'Hypoallergenic' বা 'Baby Laundry Detergent' পাওয়া যায়। এগুলো ক্ষারমুক্ত এবং উগ্র গন্ধহীন হয়। লিকুইড ডিটারজেন্ট গুঁড়া সাবানের চেয়ে ভালো, কারণ এটি পানিতে পুরোপুরি মিশে যায় এবং কাপড়ে দানা বেঁধে থাকে না।
২. ডাবল রিন্স (Double Rinse)
কাপড় ধোয়ার পর অন্তত দুইবার পরিষ্কার পানিতে চুবিয়ে নিন। ওয়াশিং মেশিনে দিলে 'Extra Rinse' অপশনটি চালু রাখুন। নিশ্চিত হোন যেন কাপড়ে সাবানের বিন্দুমাত্র গন্ধ না থাকে।
৩. ভিনেগারের জাদুকরী ব্যবহার
এটি একটি দারুণ ঘরোয়া টোটকা। কাপড় ধোয়ার শেষ পানিতে আধা কাপ সাদা সিরকা বা ভিনেগার মিশিয়ে দিন। ভিনেগার তিনটি কাজ করে:
কাপড় থেকে ডিটারজেন্টের অবশিষ্ট ক্ষার দূর করে।
প্রাকৃতিক ফ্যাব্রিক সফটনার হিসেবে কাজ করে (কাপড় নরম হয়)।
ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
ভিনেগারের গন্ধ নিয়ে চিন্তা করবেন না, শুকানোর পর গন্ধ উবে যাবে।
৪. নতুন কাপড় না ধুয়ে পরাবেন না
দোকান থেকে কেনা নতুন চকচকে কাপড়ে প্রচুর 'স্টার্চ' এবং রং ফিক্স করার কেমিক্যাল থাকে। তাই নতুন কাপড় কিনে সরাসরি বাচ্চাকে পরাবেন না। অবশ্যই একবার বেবি ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নেবেন।
৫. রোদ ও বাতাসের সঠিক ব্যবহার
চেষ্টা করুন বাচ্চার কাপড় কড়া রোদে শুকাতে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি প্রাকৃতিকভাবে জীবাণু ধ্বংস করে। তবে ঢাকার মতো শহরে যদি বারান্দায় ধুলোবালি বেশি থাকে, তবে ঘরের ভেতরে ফ্যানের নিচে শুকান, কিন্তু স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় রাখবেন না।
৬. ওয়াশিং মেশিন পরিষ্কার রাখুন
যদি মেশিনে কাপড় ধোন, তবে মাসে একবার মেশিনটি পরিষ্কার করুন। মেশিনের ড্রামে আগের ধোয়া কাপড়ের ডিটারজেন্ট জমে থাকে, যা পরের বার বাচ্চার কাপড়ে লেগে যেতে পারে।
উপসংহার
বাচ্চার ত্বকের যত্ন কেবল ভালো লোশন মাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার ত্বক যা কিছুর সংস্পর্শে আসছে, তার সবকিছুই নিরাপদ হতে হবে। আপনার একটু সচেতনতা—যেমন ডিটারজেন্টের পরিমাণ কমানো, বা সঠিক পণ্যটি বেছে নেওয়া—আপনার সন্তানকে দিতে পারে চুলকানি ও র্যাশমুক্ত শান্তিময় ঘুম। মনে রাখবেন, বাচ্চার হাসিটাই মায়ের সেরা পুরস্কার। তাই আজই চেক করুন, আপনার লন্ড্রি ডিটারজেন্টটি আপনার সন্তানের বন্ধু না শত্রু?
কোথায় পাবেন অরিজিনাল স্কিন ও বেবি কেয়ার প্রোডাক্ট?
শিশুর স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য বা আপনার নিজের ড্রাই স্কিনের জন্য অথেনটিক প্রোডাক্ট খুঁজে পাওয়া এখন বড় চ্যালেঞ্জ। নকল পণ্যের ভিড়ে বাচ্চার সুরক্ষা নিয়ে ঝুঁকি নেবেন না। আপনার এবং আপনার শিশুর শুষ্ক ত্বকের সুরক্ষায় সেরা সব ইম্পোর্টেড ব্র্যান্ডের (যেমন Aveeno Baby, CeraVe, Cetaphil) ১০০% আসল পণ্যের জন্য আমার ভরসার জায়গা TrustShopBD।
নির্দ্বিধায় ভিজিট করুন: www.trustshopbd.com
এখানে পাবেন বেবি স্কিনকেয়ার, একজিমা স্পেশাল লোশন এবং সেনসিটিভ স্কিনের জন্য উপযোগী সব সলিউশন। আপনার সোনামণির সুরক্ষায় ট্রাস্টশপবিডি-র সাথেই থাকুন।