মাছে-ভাতে বাঙালির বাজারের দীর্ঘশ্বাস
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বাজারে যাওয়ার স্মৃতি আমাদের সবারই আছে। কাদা-পানি মাড়িয়ে, মাছের বাজারের সেই তীব্র গন্ধ আর দরদামের হট্টগোল—এটাই ছিল আমাদের কালচার। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন বাজার মানেই একরাশ দুশ্চিন্তা। "মাছটা কি তাজা? নাকি ফরমালিন দেওয়া?" "দামটা কি একটু বেশিই রাখল?"—এই প্রশ্নগুলো ঢাকার প্রতিটি গৃহিণীর মনে ঘুরপাক খায়।
অন্যদিকে, গ্রামের চিত্রটা আরও করুণ। যে জেলে সারা রাত ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে নদী বা সাগরে মাছ ধরেন, সকালে ঘাটে নৌকা ভেড়ানোর পর তিনি দেখেন তাঁর কপালে জুটছে নামমাত্র মূল্য। মাঝখানে ফড়িয়া, আড়তদার আর দালালদের বিশাল সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাভের বড় অংশ।
এই যখন অবস্থা, তখন দৃশ্যপটে এলেন এক অদম্য সাহসী নারী। গতানুগতিক সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি নিয়ে এলেন একটি বৈপ্লবিক সমাধান—'স্মার্ট বাস্কেট' (Smart Basket) অ্যাপ। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই, কোনো আড়তদার নেই; অ্যাপের এক ক্লিকেই জেলের নৌকা থেকে মাছ চলে আসছে সোজা আপনার রান্নাঘরে। আজকের আর্টিকেলে আমরা শুনব সেই পরিবর্তনের গল্প, জানব কীভাবে টেকনোলজি আর নারীর মমতাময়ী নেতৃত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
আইডিয়াটা যেভাবে এল: এক নিদারুণ বাস্তবতার গল্প
গল্পের শুরুটা হয়েছিল পটুয়াখালীর এক প্রত্যন্ত জেলে পল্লীতে। আমাদের গল্পের নায়িকা (ধরি তাঁর নাম সামিয়া), একজন আরবান প্ল্যানার এবং টেক-উদ্যোক্তা, ঘুরতে গিয়েছিলেন সেখানে। তিনি দেখলেন, এক জেলে ৫ কেজি ওজনের একটি বিশাল কোরাল মাছ বিক্রি করলেন মাত্র ১৫০০ টাকায়। অথচ ঢাকায় সেই একই মাছের দাম অন্তত ৫০০০ থেকে ৬০০০ টাকা।
সামিয়া অবাক হয়ে ভাবলেন, মাঝখানের এই বিশাল অংকের টাকাটা যাচ্ছে কোথায়? তিনি দেখলেন, মাছ ঢাকায় পৌঁছাতে হাত বদল হয় অন্তত ৫ থেকে ৬ বার। প্রতিটি ধাপে মাছের গায়ে লাগে রাসায়নিক বা ফরমালিন, আর বাড়ে দাম। জেলে থাকে গরিব, আর ক্রেতা পায় বিষ। এই সিস্টেমটা ভাঙার জেদ থেকেই জন্ম নিল 'স্মার্ট বাস্কেট'।
কীভাবে কাজ করে এই 'স্মার্ট বাস্কেট'?
এটি আসলে 'উবার ফর ফিশ' (Uber for Fish)-এর মতো একটি কনসেপ্ট, কিন্তু এর গভীরতা আরও বেশি।
১. রেজিস্ট্রেশন: উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা এই অ্যাপে রেজিস্টার্ড থাকেন। যেহেতু অনেক জেলে অশিক্ষিত, তাই প্রতিটি জোনে একজন করে 'স্মার্ট এজেন্ট' (যিনি সাধারণত ওই এলাকারই শিক্ষিত তরুণী বা গৃহবধূ) থাকেন, যিনি জেলেদের সাহায্য করেন।
২. লাইভ ক্যাচ: জেলে যখন নদী বা সাগর থেকে মাছ ধরেন, তখনই নৌকায় বসে মাছের ছবি ও ভিডিও অ্যাপে আপলোড করেন। সাথে থাকে জিপিএস লোকেশন, যাতে ক্রেতা বুঝতে পারেন মাছটি কোথা থেকে ধরা।
৩. বিডিং ও প্রি-অর্ডার: শহরের গ্রাহকরা অ্যাপে ঢুকে লাইভ মাছ দেখতে পান। তারা প্রি-অর্ডার করতে পারেন।
৪. লজিস্টিকস: অর্ডার কনফার্ম হওয়ার পর, 'স্মার্ট বাস্কেট'-এর নিজস্ব কুল-চেইন (Cool Chain) ভ্যানে করে মাছ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কোনো বরফ বা কেমিক্যাল নয়, আধুনিক চিলিং বক্সে করে মাছ আসে, তাই স্বাদ থাকে একদম নদীর মতো।
নারীর নেতৃত্বে এক নতুন অধ্যায়
মৎস্য খাত বা ফিশারিজ সেক্টর বাংলাদেশে পুরোপুরি পুরুষশাসিত। ঘাটে মেয়েদের দেখা যাওয়াটাই যেখানে আশ্চর্যের, সেখানে একজন নারীর পক্ষে পুরো সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অসম্ভব কঠিন।
শুরুর দিকে স্থানীয় আড়তদাররা হুমকি দিয়েছে। "মেয়েছেলে হয়ে মাছের ব্যবসা করবে?"—এমন কটূক্তিও শুনতে হয়েছে। কিন্তু সামিয়া এবং তার টিম দমে যাননি। তিনি হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন প্রযুক্তিকে। তিনি জেলেদের বোঝালেন, "ভাই, আপনি আমাকে মাছ দিলে টাকা পাবেন নগদে এবং বাজারের চেয়ে ২০% বেশি।" পেটের দায়ে বা লাভের আশায় জেলেরা যখন একবার এই সিস্টেমে এলেন, তারা আর ফিরে যাননি। কারণ, দিনশেষে মোবাইল ওয়ালেটে (বিকাশ/নগদ) 'টং' করে টাকা ঢোকার শব্দটা তাদের বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছিল।
সিন্ডিকেট ভাঙার চ্যালেঞ্জ ও সফলতা
বাংলাদেশে সিন্ডিকেট ভাঙা আর বাঘের মুখে হাত দেওয়া একই কথা। কারওয়ান বাজারের বা যাত্রাবাড়ীর আড়তদাররা যখন দেখলেন তাদের ব্যবসায় ভাটা পড়ছে, তারা নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কখনো রাস্তায় ভ্যান আটকে দেওয়া, কখনো জেলেদের 'দাদন' (সুদে টাকা) দিয়ে আটকে রাখা।
কিন্তু 'স্মার্ট বাস্কেট' একটি অভিনব কাজ করল। তারা জেলেদের মাইক্রো-লোন বা ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে দিল বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায়। ফলে জেলেরা মহাজনদের সুদ বা দাদনের জাল থেকে মুক্তি পেল। এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জেলেদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এখন ভোলা, বরগুনা বা কক্সবাজারের জেলেরা জানেন, তাদের একটি স্মার্টফোন আছে, আর আছে ঢাকায় বসে থাকা হাজার হাজার কাস্টমার। মাঝখানের দালালদের তাদের আর প্রয়োজন নেই।
ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা: ফরমালিন আতঙ্কের অবসান
ঢাকার গুলশানের বাসিন্দা মিসেস রেহানা বলছিলেন, "আগে মাছ কিনলে বাসায় এনে লবন-পানিতে ভিজিয়ে রাখতাম ভয়ে। বাচ্চার পেটে কী দিচ্ছি, এই চিন্তায় ঘুম আসত না। স্মার্ট বাস্কেট অ্যাপে যখন প্রথম ইলিশ অর্ডার করলাম, বিশ্বাস করুন, প্যাকেট খোলার পর মনে হলো যেন মাত্রই পদ্মা থেকে তুলে আনা হয়েছে। মাছের গায়ের সেই পিচ্ছিল ভাব আর চোখের স্বচ্ছতা দেখলেই বোঝা যায় এটা কতটা ফ্রেশ।"
এই বিশ্বাসটাই 'স্মার্ট বাস্কেট'-এর আসল পুঁজি। অ্যাপটিতে 'ট্রেসেবিলিটি' (Traceability) ফিচার আছে। অর্থাৎ, আপনি যে মাছটি খাচ্ছেন, সেটি কোন জেলের জালে, কখন ধরা পড়েছিল এবং কোন রুটে আপনার বাসায় এল—সবকিছু ম্যাপে দেখা যায়। খাদ্যে ভেজালের এই যুগে এটি এক বিশাল স্বস্তি।
নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন
শুধু প্রতিষ্ঠাতা নারী বলে নয়, এই প্রজেক্টের প্রতিটি ধাপে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
সর্টিং ও প্যাকেজিং: মাছ ঢাকায় আসার পর সেগুলো গ্রেডিং বা বাছাই করা এবং আধুনিক ভ্যাকুয়াম প্যাকেজিংয়ের কাজ করেন নারীরা।
স্মার্ট এজেন্ট: গ্রামে গ্রামে যারা জেলেদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছেন, তারা অনেকেই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী। তারা এর মাধ্যমে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: মাছ পেরিয়ে সবজিতে
'স্মার্ট বাস্কেট' কেবল মাছেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। তাদের লক্ষ্য এবার কৃষকের সবজি। বগুড়ার বা নরসিংদীর কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত সবজি সরাসরি ঢাকার ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে দিতে পারেন, সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে।
সামিয়া বলেন, "আমরা চাই বাংলাদেশে এমন একটি ইকো-সিস্টেম তৈরি করতে, যেখানে উৎপাদক পাবে তার ঘামের সঠিক মূল্য, আর ভোক্তা পাবে শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের কৃষি ও বাজার ব্যবস্থাকে স্মার্ট করতেই হবে।"
উপসংহার
প্রযুক্তি যে কেবল চ্যাটিং বা গেমিংয়ের জন্য নয়, বরং এটি যে মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে—তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত 'স্মার্ট বাস্কেট'। একজন নারীর হাত ধরে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ আজ হাজারো জেলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আর আমরা যারা শহরের চার দেয়ালে বন্দি, আমাদের দিয়েছে একটু খাঁটি স্বাদের নিশ্চয়তা।
আপনার মোবাইলের ছোট্ট একটি অ্যাপ যদি একজন জেলের সংসার বাঁচাতে পারে এবং আপনার পরিবারকে সুস্থ রাখতে পারে, তবে তাকে আলিঙ্গন না করার কোনো কারণ নেই। 'স্মার্ট বাস্কেট' কেবল একটি অ্যাপ নয়, এটি একটি বিপ্লব—সততার বিপ্লব, শুদ্ধতার বিপ্লব।