https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটির ও হস্তশিল্প: আমাদের শেকড়, আমাদের অহংকার এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ

top-news
  • 01 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

হাজার বছরের ঐতিহ্যের ক্যানভাস

বাংলাদেশ মানেই সুজলা-সুফলা প্রকৃতি আর তার কোলে বেড়ে ওঠা হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো আমাদের কুটির ও হস্তশিল্প। যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে দাঁড়িয়ে, ২০২৫ সালে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবোটিক্স বিশ্ব কাঁপাচ্ছে, তখনো বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো এক উঠোনে বসে সুই-সুতোয় নকশা তোলা গ্রামীণ নারী কিংবা তাঁতের খটখট শব্দে মগ্ন কারিগর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা কে, আমাদের শেকড় কোথায়।

বাংলাদেশের হস্তশিল্প বা 'হ্যান্ডিক্রাফটস' কোনো সাধারণ শৌখিন পণ্য নয়। এটি আবহমান বাংলার জীবনযাপন, ধর্ম, প্রকৃতি এবং মানুষের মনের মাধুরীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন, এমনকি পাকিস্তান আমলের শোষণ—সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলার কারিগররা তাদের এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এটি আমাদের অর্থনীতির চাকা যেমন সচল রেখেছে, তেমনি বিশ্বদরবারে আমাদের দিয়েছে এক অনন্য পরিচিতি। আজকের এই লেখায় আমরা গভীরে গিয়ে দেখব বাংলাদেশের প্রধান প্রধান হস্তশিল্পগুলোকে এবং বুঝব কেন এগুলো আমাদের অস্তিত্বের অংশ।

১. জামদানি: সুতোর বুননে কবিতার ছন্দ

বাংলাদেশের হস্তশিল্পের কথা উঠলেই সবার আগে আসে জামদানির নাম। ইউনেস্কো কর্তৃক 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ' বা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া জামদানি শুধু শাড়ি নয়, এটি এক টুকরো ইতিহাস। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের আর্দ্র আবহাওয়া, বিশেষ ধরনের পানি এবং কারিগরের বংশপরম্পরায় লব্ধ জ্ঞান—এই তিনে মিলে তৈরি হয় জামদানি।

২০২৫ সালে এসে জামদানির নকশায় এসেছে আধুনিকতা, কিন্তু বুনন কৌশল সেই আদি ও অকৃত্রিম। জ্যামিতিক নকশা, ফুল, লতাপাতা যখন শাড়ির জমিনে ফুটে ওঠে, তখন তা হয়ে ওঠে এক একটি মাস্টারপিস। 'তেরছা', 'জলপাড়', 'পান্না হাজার'—নকশাগুলোর নাম শুনলেই বোঝা যায় কতটা কাব্যিক এই শিল্প। বিয়ে থেকে শুরু করে যেকোনো উৎসবে বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ জামদানি। এটি আমাদের আভিজাত্যের প্রতীক। বর্তমানে ই-কমার্সের কল্যাণে ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে জামদানি পৌঁছে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাশন সচেতন মানুষের কাছে।

২. নকশী কাঁথা: সুই-সুতোয় লেখা সুখ-দুঃখের গল্প

"যে মাঠ থেকে আলতো পায়ে খুকি, কলসি কাঁখে মেঠো পথটি বেয়ে..." জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠের সেই আবেগ আজও জীবন্ত। নকশী কাঁথা বাংলার গ্রামীণ নারীদের একান্ত নিজস্ব শিল্প। পুরনো শাড়ির কাপড় স্তরে স্তরে সাজিয়ে, রঙ-বেরঙের সুতো দিয়ে তারা যখন ফোঁড় তোলেন, তখন তার সাথে গেঁথে যায় তাদের সংসারের গল্প, হাসি-কান্না আর স্বপ্নের কথা।

আগে এটি ছিল কেবল নিজেদের ব্যবহারের জন্য। বর্ষার অলস দুপুরে বা শীতের বিকেলে পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে কাঁথা সেলাই করতেন। কিন্তু এখন নকশী কাঁথা একটি বিশাল শিল্প। যশোর, জামালপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলের নকশী কাঁথা বিশ্বখ্যাত। এখন আর শুধু কাঁথা নয়; বেডকভার, ওয়ালম্যাট, কুশন কভার, এমনকি মেয়েদের পোশাকেও নকশী কাজের ব্যবহার বাড়ছে। ২০২৫ সালের টেকসই ফ্যাশন বা 'সাসটেইনেবল ফ্যাশন' ট্রেন্ডে নকশী কাঁথা এক বড় জায়গা করে নিয়েছে কারণ এটি 'আপসাইক্লিং'-এর (পুরনো জিনিস নতুন করে ব্যবহার) সেরা উদাহরণ।

৩. মৃৎশিল্প: মাটির মায়ায় গড়া রূপকথা

এদেশের মানুষের পায়ের নিচে মাটি, মনেও মাটি। তাই মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। কুমারপাড়ার চাকা ঘোরার দৃশ্য এখন কমে এলেও, মাটির তৈরি জিনিসের কদর কমেনি। পাল রাজাদের আমল থেকেই বাংলায় পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার কাজ বিখ্যাত। কান্তজির মন্দির বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের গায়ের টেরাকোটা তার প্রমাণ।

আজকের দিনে শখের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, আর আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনে টেরাকোটার টাইলস ব্যাপক জনপ্রিয়। পহেলা বৈশাখের মেলায় মাটির পুতুল, হাতি-ঘোড়া ছাড়া যেন উৎসবই জমে না। ঢাকার আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোতে এখন প্লাস্টিকের বদলে মাটির তৈজসপত্রের ব্যবহার বাড়ছে, যা স্বাস্থ্যসচেতনতার পাশাপাশি নান্দনিকতারও পরিচয় দেয়।

৪. পাটশিল্প: সোনালী আঁশের নবজাগরণ

একসময় পাট ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। মাঝখানে প্লাস্টিকের দাপটে এই শিল্প কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও, বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে পাট আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাচ্ছে। একে বলা হচ্ছে 'গোল্ডেন ফাইবার অফ ফিউচার'।

এখন শুধু চট বা বস্তা নয়, পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে উচ্চমানের জুতো, ব্যাগ, কার্পেট, শোপিস, এমনকি শাড়ির কাপড়ও। জুটন বা পাটের তৈরি কাপড় ফ্যাশন দুনিয়ায় নতুন সমীকরণ যোগ করেছে। বাংলাদেশের দক্ষ কারিগররা পাটের আঁশ দিয়ে এমন সূক্ষ্ম সব পণ্য তৈরি করছেন যা দেখে বোঝার উপায় নেই এটি পাটের তৈরি। আমাদের কুটির শিল্পের এই খাতটি গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করতে বিশাল ভূমিকা রাখছে।

৫. বাঁশ ও বেত শিল্প: প্রকৃতির উপহার

বাংলার প্রকৃতিতে বাঁশ ও বেত অত্যন্ত সহজলভ্য। আর এই সহজলভ্য উপাদান দিয়েই কারিগররা তৈরি করেন অসাধারণ সব আসবাব ও ব্যবহার্য সামগ্রী। বেতের সোফা, দোলনা, বা বাঁশের তৈরি ল্যাম্পশেড—এগুলো এখন শুধু গ্রামের কুঁড়েঘরে নয়, শোভা পাচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেলের লবিতেও।

সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেত শিল্পের দারুণ প্রসার ঘটেছে। শীতল পাটি—যা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে, তা তৈরি হয় বেত গাছেরই একটি প্রজাতি থেকে। গরমে শীতল পাটিতে শরীর জুড়ানোর আরাম বাঙালি ছাড়া আর কে বুঝবে? এই শিল্পগুলো পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী, যা বর্তমান বিশ্বের 'ইকো-ফ্রেন্ডলি' জীবনযাপনের সাথে পুরোপুরি মানানসই।

৬. ধাতব শিল্প: ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল

ঢাকার কাছেই ধামরাই এলাকাটি কাঁসা-পিতল শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে ব্যবহৃত হয় হাজার বছরের পুরনো 'লস্ট ওয়াক্স প্রসেস' বা মোম গলানোর পদ্ধতি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার সামগ্রী থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর শৌখিন মূর্তি, থালা-বাসন—সবই তৈরি হয় নিপুণ হাতে। কাঁসার থালায় গরম ভাত খাওয়ার তৃপ্তিই আলাদা। এই শিল্পটি আমাদের ধাতুবিদ্যার প্রাচীন জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। যদিও কাঁচামালের দাম বাড়ায় এই শিল্প সংকটে, তবুও কিছু কারিগর বংশপরম্পরায় এটি টিকিয়ে রেখেছেন।

৭. শঙ্খ ও ঝিনুক শিল্প

সমুদ্রতীরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে শঙ্খ ও ঝিনুক শিল্পের রয়েছে আলাদা কদর। কক্সবাজার ও কুয়াকাটা অঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়। শঙ্খের তৈরি গহনা, শাঁখা বাঙালি হিন্দু বিবাহিত নারীদের ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া ঝিনুক দিয়ে তৈরি করা হয় নানা ধরনের শোপিস, যা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

সাংস্কৃতিক গুরুত্ব: কেন এই শিল্প আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে?

বাংলাদেশের হস্তশিল্প শুধু পণ্য কেনা-বেচার বিষয় নয়। এর পেছনে রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য।

  • জাতীয় পরিচয়: জামদানি বা নকশী কাঁথা দেখলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ বলে দিতে পারে এটি বাংলাদেশের। এটি আমাদের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য, যা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের বাহক।

  • নারীর ক্ষমতায়ন: কুটির শিল্পের সাথে যুক্ত ৯০ শতাংশই নারী। ঘরে বসে সংসারের কাজের পাশাপাশি তারা এই কাজ করেন। এর মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাচ্ছেন, যা গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান পরিবর্তন করছে।

  • ধর্মীয় ও সামাজিক মেলবন্ধন: পূজা-পার্বণ, ঈদ, বিয়ে বা পহেলা বৈশাখ—সব উৎসবই আমাদের হস্তশিল্পের সাথে জড়িত। আলপনা আঁকা, মাটির প্রদীপ জ্বালানো, জামদানি পরা—এসবই আমাদের উৎসবের প্রাণ।

  • টেকসই উন্নয়ন: জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের বিকল্প নেই। আমাদের হস্তশিল্পগুলো শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।

ভবিষ্যৎ ভাবনা ও উপসংহার

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি এক নতুন সম্ভাবনা। প্রযুক্তি এখন আর হস্তশিল্পের শত্রু নয়, বরং বন্ধু। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে কুষ্টিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের কারিগর তার পণ্য বিক্রি করছেন ঢাকার বা নিউ ইয়র্কের ক্রেতার কাছে। তবে চ্যালেঞ্জও আছে। কাঁচামালের অভাব, কারিগরদের ন্যায্য মজুরি না পাওয়া এবং মেশিনে তৈরি সস্তা পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা এই শিল্পের বড় বাধা।

আমাদের দায়িত্ব হলো দেশি পণ্যকে ভালোবাসা। ঘর সাজাতে বিদেশি প্লাস্টিকের ফুল না কিনে দেশি মাটির ফুলদানি বা পাটের শোপিস কিনলে তা শুধু আপনার রুচির পরিচয় দেবে না, বরং একজন কারিগরের মুখে হাসি ফোটাবে। সরকারকে এই কারিগরদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের হস্তশিল্প আমাদের আত্মার আত্মীয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা এক সৃজনশীল জাতি। যতদিন বাঙালির হাতে নিপুণতা থাকবে, যতদিন বাংলার মাটিতে সোনা ফলবে, ততদিন এই শিল্প বেঁচে থাকবে স্বমহিমায়। আসুন, আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করি, লালন করি এবং গর্বের সাথে বিশ্বকে বলি—"এটাই আমার বাংলাদেশ, এটাই আমার শিল্প।"

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *