স্বপ্ন যখন চার দেয়ালের বাইরে
আমাদের দেশের মায়েদের, তা তিনি গ্রামের টিনের চালের ঘরেই থাকুন কিংবা শহরের বহুতল ফ্ল্যাটে—সবার মধ্যেই একটা সুপ্ত প্রতিভা থাকে। কেউ চমৎকার নকশি কাঁথা সেলাই করতে পারেন, কেউ ভালো আচার বানাতে পারেন, আবার কেউ হয়তো পুঁতির গয়না বা কুশিকাটায় দারুণ পারদর্শী। সংসারের ঘানি টানতে টানতে এই প্রতিভাগুলো অনেক সময় আলমারির তাকে বা ট্রাঙ্কবন্দী হয়েই থেকে যায়।
কিন্তু দিন বদলেছে। এখন আর পণ্য বিক্রি করতে হাটে বা বাজারে দোকান নিতে হয় না। আপনার হাতের স্মার্টফোনটিই আপনার সবচেয়ে বড় দোকান। বর্তমানে বাংলাদেশে 'এফ-কমার্স' (Facebook Commerce) বা অনলাইন বিজনেসের যে বিপ্লব ঘটেছে, তার বড় একটা অংশের কান্ডারি আমাদের নারীরা। তবুও, শুরুটা কীভাবে করবেন? গ্রাম থেকে কীভাবে ঢাকায় পণ্য পাঠাবেন? কিংবা শহরের তীব্র প্রতিযোগিতায় কীভাবে টিকবেন? এই প্রশ্নগুলো হাজারো মায়ের মনে ঘুরপাক খায়। আজ আমরা কোনো মোটিভেশনাল বুলি আওড়াব না, বরং একদম মাটির কাছাকাছি থেকে বাস্তব সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
১. পণ্য নির্বাচন: আপনি আসলে কী বিক্রি করবেন?
অনেকেই ভাবেন, "সবাই তো থ্রি-পিস বিক্রি করছে, আমিও তাই করি।" এটা সবচেয়ে বড় ভুল। অনলাইন ব্যবসায় টিকে থাকার প্রথম মন্ত্র হলো 'ইউনিক' বা আলাদা কিছু করা।
গ্রামের মায়েদের জন্য: আপনাদের হাতের কাছে এমন কিছু সম্পদ আছে যা শহরের মানুষের কাছে সোনার চেয়েও দামী। যেমন—খাঁটি গাওয়া ঘি, হাতের তৈরি কুমড়ো বড়ি, নকশি পাখা, শীতল পাটি, কিংবা একদম অর্গানিক চালের গুঁড়া। শহরের মানুষ এখন 'অর্গানিক' বা 'দেশি' জিনিসের জন্য পাগল। আপনি যদি ভালো মানের বাঁশের ঝুড়িও বানাতে পারেন, সেটাও অনলাইনে চড়া দামে বিক্রি সম্ভব।
শহরের মায়েদের জন্য: শহরে কাঁচামাল বা জায়গা পাওয়া কঠিন। আপনারা ফোকাস করতে পারেন কাস্টমাইজড আইটেমে। যেমন—হ্যান্ডপেইন্টেড টিপ, মাটির গয়না, হোমমেড কেক বা স্ন্যাকস, কিংবা রিসাইকেল করা কাপড়ের ব্যাগ। শহরের মায়েরা 'ভ্যালু এডিশন' বা পণ্যের মানোন্নয়নে বেশি নজর দিতে পারেন।
২. কোয়ালিটি বনাম ফিনিশিং: আসল জাদু হাতের ছোঁয়ায়
হাতে বানানো পণ্যের মূল আকর্ষণ হলো এর 'ফিনিশিং'। মেশিনে বানানো জিনিসের মতো সব একরকম হবে না, কিন্তু তাতে যেন অযত্ন না থাকে।
মনে রাখবেন, কাস্টমার যখন আপনার কাছ থেকে একটি কুশিকাটার জামা বা এক বোতল আচার কিনছেন, তিনি কিন্তু শুধু পণ্য কিনছেন না; তিনি আপনার শ্রম আর ভালোবাসা কিনছেন। আচারের বয়ামের মুখে যদি তেল লেগে থাকে, কিংবা সেলাইয়ের সুতো যদি আলগা থাকে—তবে কাস্টমার দ্বিতীয়বার ফিরবেন না। প্যাকেজিংয়ে একটু নান্দনিকতা আনুন। পাটের রশি বা একটু হাতে লেখা চিরকুট—এই ছোট বিষয়গুলো কাস্টমারের মনে দাগ কাটে।
৩. মোবাইল ফটোগ্রাফি: ছবিই যখন কথা বলে
অনলাইনে মানুষ পণ্য ধরে দেখতে পারে না, শুধু ছবি দেখেই অর্ডার করে। তাই ছবি তোলাই হলো আপনার ব্যবসার অর্ধেক কাজ। এর জন্য দামী ডিএসএলআর (DSLR) ক্যামেরা লাগবে না।
আলোর খেলা: ঘরের লাইট বন্ধ করে জানালার পাশে পণ্যটি রাখুন। দিনের আলো বা 'ন্যাচারাল লাইট' হলো পণ্যের ছবির জন্য সেরা।
ব্যাকগ্রাউন্ড: আচারের বোতল বা গয়নার নিচে একটা সাদা বা একরঙা কাপড় বিছিয়ে দিন। ব্যাকগ্রাউন্ড যত সিম্পল হবে, পণ্য তত ফুটে উঠবে।
অ্যাঙ্গেল: ওপর থেকে, পাশ থেকে এবং ক্লোজ-আপ—অন্তত ৩-৪টি অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলুন। কাস্টমার ডিটেইলস দেখতে চায়।
এডিটিং: মোবাইলের সাধারণ এডিটিং অ্যাপ দিয়ে ব্রাইটনেস একটু বাড়িয়ে নিন, তবে কালার বা রং পরিবর্তন করবেন না। ছবিতে যা, বাস্তবেও তাই—এটা বজায় রাখা খুব জরুরি।
৪. প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন: পেজ, গ্রুপ নাকি ওয়েবসাইট?
শুরুতেই ওয়েবসাইট খোলার দরকার নেই। বাংলাদেশে ফেসবুকই হলো ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।
ফেসবুক পেজ: নিজের ব্র্যান্ডের নামে একটা সুন্দর পেজ খুলুন। সব আপডেট এখানেই দেবেন।
সেলিং গ্রুপ: উই (WE) বা অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের অনেক গ্রুপ আছে। সেখানে নিজের কাজের গল্প বলুন। শুধু "দাম কত" বা "কিনুন" না লিখে, পণ্যটি কীভাবে বানালেন, কেন বানালেন—সেই গল্প লিখুন। মানুষ গল্প শুনতে পছন্দ করে। একে বলা হয় 'স্টোরিটেলিং মার্কেটিং'।
হোয়াটসঅ্যাপ: পরিচিত কাস্টমারদের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ ব্রডকাস্ট লিস্ট করতে পারেন। নতুন পণ্য এলেই তাদের ছবি পাঠিয়ে দিন।
৫. দাম নির্ধারণ: আবেগের দাম কত?
হাতের কাজের পণ্যের দাম ঠিক করা সবচেয়ে কঠিন। মায়েরা প্রায়ই ভুল করে শুধু কাঁচামালের দামটা ধরেন, নিজের শ্রমের দাম ধরেন না।
সূত্রটি হলো:
(কাঁচামাল খরচ + যাতায়াত খরচ + প্যাকেজিং + আপনার শ্রমের ঘণ্টা প্রতি মূল্য + লাভ) = বিক্রয় মূল্য।
ধরুন, একটি কাঁথা সেলাই করতে আপনার ১ মাস লাগলো। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। আপনার ঘণ্টার দাম যদি ৫০ টাকাও ধরেন, তবে শ্রমের মূল্যই অনেক। সস্তায় বিক্রি করবেন না। যারা হাতের কাজের কদর বোঝে, তারা সঠিক দাম দিয়েই কিনবে।
৬. ডেলিভারি ও লজিস্টিকস: আসল চ্যালেঞ্জ
গ্রামের বা শহরের—সব উদ্যোক্তার একটাই মাথাব্যথা, সেটা হলো ডেলিভারি।
গ্রামের ক্ষেত্রে: এখন সুন্দরবন, এসএ পরিবহন ছাড়াও অনেক কুরিয়ার সার্ভিস (যেমন: স্টেডফাস্ট, পাঠাও) ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আপনার নিকটস্থ এজেন্টের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন। অনেক সময় তারা এসে পণ্য নিয়ে যায়। আর পচনশীল দ্রব্য (যেমন খাবার) পাঠাতে হলে বাস সার্ভিস বা পরিচিত ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ।
শহরের ক্ষেত্রে: শহরের ভেতরে 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' (COD) এখন খুব সহজ। রেডএক্স (RedX), পেপারফ্লাই বা ই-কুরিয়ারের মতো অনেক সার্ভিস আছে যারা বাসা থেকে পার্সেল নিয়ে যায়।
পেমেন্ট: নতুন অবস্থায় কাস্টমাররা অ্যাডভান্স টাকা দিতে চায় না। সেক্ষেত্রে শুধু ডেলিভারি চার্জটা আগে বিকাশে বা নগদে নিয়ে নিতে পারেন। এতে কাস্টমার পার্সেল রিসিভ না করলে আপনার অন্তত ডেলিভারি চার্জের লস হবে না।
৭. সংসার ও ব্যবসা: ব্যালেন্স করবেন কীভাবে?
এটিই আমাদের মায়েদের জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। সকালে নাস্তা বানানো, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, দুপুরের রান্না, বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা—এর ফাঁকে ব্যবসা।
রুটিন: দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ব্যবসার জন্য বরাদ্দ রাখুন। হতে পারে সেটা দুপুরে সবাই ঘুমানোর পর, কিংবা রাতে।
পরিবারকে বোঝানো: স্বামীকে বা পরিবারের সদস্যদের আপনার কাজের গুরুত্ব বোঝান। তাদের ছোট ছোট কাজে সাহায্য করতে বলুন। যেমন—পার্সেলটা প্যাক করে দেওয়া বা কুরিয়ারে দিয়ে আসা। যখন তারা দেখবে এখান থেকে আয় হচ্ছে, তখন তারাও সাপোর্টিভ হবে।
৮. ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতা
প্রথম মাসেই হাজার হাজার টাকার অর্ডার আসবে না। হয়তো প্রথম দুই মাস কোনো অর্ডারই নেই। হতাশ হবেন না। ফেসবুকে নিয়মিত পোস্ট করতে থাকুন। সপ্তাহে অন্তত একদিন লাইভে এসে নিজের পণ্য দেখান। নিজের মুখের কথা এবং কনফিডেন্স কাস্টমারকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে।
উপসংহার
একজন মা যখন উদ্যোক্তা হন, তখন তিনি শুধু টাকা আয় করেন না, তিনি তার সন্তানের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। গ্রাম থেকে পাঠানো এক বয়াম আচার যখন ঢাকার ডাইনিং টেবিলে জায়গা করে নেয়, তখন সেটা শুধু আচার থাকে না, সেটা হয়ে যায় এক নারীর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
শুরুটা কঠিন হতে পারে, ভুল হতে পারে, পার্সেল রিটার্ন আসতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, নিজের উপার্জনের টাকায় সন্তানের জন্য কেনা প্রথম উপহারের আনন্দ পৃথিবীর আর কিছুর সাথে মেলানো যায় না। তাই আজই আপনার সুপ্ত প্রতিভাকে ধুলো ঝেড়ে বের করুন। পৃথিবী আপনার হাতের জাদুর অপেক্ষায় আছে।