আবেগের সাথে যখন বাস্তবতার মেলবন্ধন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তা ঘরে বসেই নিজেদের সৃজনশীলতাকে ব্যবসায় রূপান্তর করছেন। কেউ বানাচ্ছেন পাটের ব্যাগ, কেউ মাটির গহনা, আবার কেউ বা অর্গানিক হেয়ার অয়েল বা ফেসপ্যাক। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে তখন, যখন একটি পণ্য তৈরি করার পর মনে প্রশ্ন জাগে—"এটার দাম কত রাখবো?"
দাম বেশি চাইলে কাস্টমার চলে যাওয়ার ভয়, আর কম চাইলে নিজের পরিশ্রমের মূল্য থাকে না। বিশেষ করে আমাদের এশিয়ান কালচারে "দরাদরি" বা বার্গেইন করার প্রবণতা এত বেশি যে, সঠিক দাম নির্ধারণ করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে তো লজ্জায় নিজের শ্রমের মজুরিটাই ধরেন না। ফলাফল—মাসের পর মাস কাজ করেও লাভের মুখ দেখা যায় না। আজ আমরা একদম খাঁটি বাংলা আড্ডার ছলে শিখব, কীভাবে আপনার হ্যান্ডিক্রাফটস বা বিউটি প্রোডাক্টের এমন দাম নির্ধারণ করবেন, যাতে কাস্টমারও খুশি থাকে এবং আপনার পকেটেও লাভের টাকা ঢোকে।
১. ভুল ধারণা: "খরচ যা, তার দ্বিগুণ দাম"
অনেকে মনে করেন, ১০০ টাকার কাঁচামাল কিনলে ২০০ টাকা দাম ধরলেই প্রচুর লাভ। এটি ব্যবসার জগতে সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ, আপনি কেবল কাঁচামাল বা Raw Material-এর হিসাব করছেন। কিন্তু সেই পণ্যটি আনতে আপনার রিকশা ভাড়া, তৈরি করতে কারেন্ট বিল, ইন্টারনেট বিল, প্যাকেজিং এবং সবচেয়ে বড় কথা—আপনার নিজের সময়ের মূল্য কোথায় গেল?
২. প্রাইসিং বা দাম নির্ধারণের গোল্ডেন ফর্মুলা
সঠিক দাম বের করার জন্য একটি সহজ সূত্র বা ফর্মুলা মেনে চলা উচিত। এটি বিশ্বজুড়ে ছোট ব্যবসার জন্য স্বীকৃত।
সূত্র:
(কাঁচামাল খরচ + শ্রমের মূল্য + আনুষঙ্গিক খরচ) + লাভের শতাংশ = পাইকারি দাম
(পাইকারি দাম x ২ অথবা ১.৫) = খুচরা বা রিটেইল দাম
আসুন, প্রতিটি ধাপ বিস্তারিত আলোচনা করি।
ধাপ ১: কাঁচামালের সঠিক হিসাব (Material Cost)
ধরি, আপনি একটি অর্গানিক ফেসপ্যাক বা হ্যান্ডপেইন্ট করা শাড়ি বিক্রি করেন।
কাঁচামাল মানে শুধু শাড়ি বা ফেসপ্যাকের পাউডার নয়।
শাড়ির ক্ষেত্রে: শাড়ি, রং, তুলি, মিডিয়াম, অ্যাপ্লিকার বা চুমকি।
বিউটি প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে: হার্বস, তেল, প্রিজারভেটিভ (যদি থাকে), বোতল বা জার।
টিপস: সুতা, আঠা বা ছোট স্টিকারের দামও হিসাবের মধ্যে আনতে হবে। এক ফোঁটা আঠার দামও কিন্তু আপনার পকেট থেকেই যাচ্ছে। ১০-২০% অতিরিক্ত ধরে রাখবেন "Wastage" বা অপচয়ের জন্য। কারণ সব কাজ নিখুঁত হয় না, কিছু নষ্ট হতেই পারে।
ধাপ ২: শ্রমের মূল্য বা মজুরি (Labor Cost) – নিজেকে ফাঁকি দেবেন না
আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা নিজেকে "ফ্রি লেবার" মনে করেন। ভাবেন, "আমিই তো বানাচ্ছি, টাকা নিয়ে কী হবে?" কিন্তু আপনি যদি এই কাজটা না করে অন্য কোথাও চাকরি করতেন, তবে কি বেতন পেতেন না?
আপনার শ্রমের একটা ঘণ্টা ভিত্তিক রেট (Hourly Rate) ঠিক করুন।
ধরুন, আপনি ঠিক করলেন আপনার প্রতি ঘণ্টার কাজের মূল্য ১০০ টাকা।
একটি শাড়ি পেইন্ট করতে যদি ১০ ঘণ্টা সময় লাগে, তবে আপনার শ্রমের মূল্য = ১০ x ১০০ = ১০০০ টাকা।
এই ১০০০ টাকা পণ্যের দামের সাথে যুক্ত হবে। এটি আপনার লাভ নয়, এটি আপনার মজুরি।
ধাপ ৩: আনুষঙ্গিক বা অদৃশ্য খরচ (Overheads)
এই খরচগুলো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ব্যবসার টাকা শুষে নেয়।
বিদ্যুৎ বিল: ফ্যান বা লাইট জ্বালিয়ে কাজ করছেন, ব্লেন্ডার চালাচ্ছেন।
ইন্টারনেট/ডাটা: ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, কাস্টমারের সাথে চ্যাট করছেন।
পরিবহন: কাঁচামাল কিনতে নিউমার্কেট বা চকবাজার যাওয়ার ভাড়া।
টুলস: কাঁচি, ব্রাশ, বাটি—এগুলো কিছুদিন পর পর বদলাতে হয়।
মার্কেটপ্লেস চার্জ: যদি দারাজ বা অন্য কোনো সাইটে বিক্রি করেন, তারা একটা কমিশন কাটে।
সহজ উপায় হলো, কাঁচামাল ও শ্রমের মোট যোগফলের ওপর ১০-১৫% এই 'অদৃশ্য খরচ' হিসেবে যোগ করা।
ধাপ ৪: প্যাকেজিং ও ব্র্যান্ডিং (Packaging)
বাংলাদেশে এখন প্রোডাক্টের মানের চেয়েও "আনবক্সিং এক্সপেরিয়েন্স" বা প্যাকেজিং বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি যদি একটি সুন্দর বক্সে, টিস্যু পেপার দিয়ে, একটা 'থ্যাংক ইউ' কার্ড ও স্টিকার সহ পণ্য দেন, কাস্টমার ৫০ টাকা বেশি দিতেও কার্পণ্য করবে না।
বাবল র্যাপ, টেপ, বক্স, ফিতা—প্রতিটি জিনিসের দাম পণ্যের গায়ের দামের সাথে যোগ হবে। পকেট থেকে দেবেন না।
ধাপ ৫: লাভের অংক (Profit Margin)
সব খরচ যোগ করার পর এবার আসবে ব্যবসার লাভ। মনে রাখবেন, "শ্রমের মূল্য" আপনার ব্যক্তিগত টাকা, আর "লাভ" হলো ব্যবসার টাকা, যা দিয়ে ব্যবসা বড় করবেন।
সাধারণত হ্যান্ডিক্রাফটস বা বিউটি প্রোডাক্টে ২০% থেকে ৫০% পর্যন্ত লাভ ধরা হয়। যদি আপনার পণ্যটি খুব ইউনিক হয় (যেমন কাস্টমাইজড গহনা), তবে লাভ আরও বেশি হতে পারে।
বাস্তব উদাহরণ: একটি অর্গানিক হেয়ার অয়েলের দাম নির্ধারণ
আসুন একটি কাল্পনিক হিসাব করি ১০০ এম.এল. তেলের জন্য:
১. কাঁচামাল: নারকেল তেল, আমলকি, মেথি, জবা ফুল, এসেনশিয়াল অয়েল = ১২০ টাকা।
২. বোতল ও স্টিকার: ৩০ টাকা।
৩. শ্রম: তেল জ্বাল দিতে ও বোতলজাত করতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা। (ধরি ঘণ্টায় ৫০ টাকা রেট) = ৫০ টাকা।
৪. আনুষঙ্গিক (গ্যাস, কারেন্ট, যাতায়াত): ২০ টাকা।
মোট উৎপাদন খরচ: ১২০ + ৩০ + ৫০ + ২০ = ২২০ টাকা।
এখন, আপনি যদি ২০% লাভ করতে চান:
২২০ টাকার ২০% = ৪৪ টাকা।
পাইকারি/ন্যূনতম দাম: ২২০ + ৪৪ = ২৬৪ টাকা।
এখন আপনি যদি এটি খুচরা বা রিটেইল কাস্টমারের কাছে বিক্রি করেন, তবে আপনাকে মার্কেটিং কস্ট বা ডিসকাউন্ট দেওয়ার জায়গা রাখতে হবে। তাই এর সাথে আরও ৩০-৪০% যোগ করতে পারেন।
খুচরা দাম: ২৬৪ + ৮০ (মার্কেটিং ও বাফার) = ৩৪৪ বা ৩৫০ টাকা।
দেখলেন তো? শুধু তেলের দাম ১২০ টাকা দেখে যদি ২০০ টাকায় বিক্রি করতেন, তবে আসলে আপনার লস হতো!
৩. বাজার যাচাই ও সাইকোলজিক্যাল প্রাইসিং
দাম ঠিক করার আগে একটু মার্কেট রিসার্চ করুন। আড়ং, যাত্রা বা ইনস্টাগ্রামের জনপ্রিয় পেজগুলো একই জিনিসের দাম কত রাখছে? তাদের কোয়ালিটি আর আপনার কোয়ালিটি কি এক?
যদি দেখেন সবাই ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছে, আপনি হুট করে ৬০০ টাকা চাইলে বিক্রি হবে না। আবার ২০০ টাকা চাইলেও মানুষ ভাববে—"নিশ্চয়ই ভেজাল আছে।"
সাইকোলজিক্যাল টিপস:
দামের শেষে ৯ বা ৫ ব্যবহার করুন। যেমন: ৫০০ টাকার বদলে ৪৯০ টাকা বা ৪৯৫ টাকা। মানুষের ব্রেইন এটাকে "৪০০-এর ঘর" হিসেবে কাউন্ট করে, যা সস্তা মনে হয়।
৪. "আপু, ডিসকাউন্ট হবে না?" – এই পরিস্থিতি সামলানোর উপায়
বাঙালি কাস্টমার মানেই ডিসকাউন্ট চাইবে। এটা তাদের দোষ না, এটা আমাদের সংস্কৃতি। এজন্য প্রাইসিং করার সময় হাতে ১০-১৫% বাফার বা বাড়তি দাম ধরে রাখবেন।
যখন কাস্টমার বলবে "কম রাখেন", তখন আপনি সেই বাড়তি অংশটা কমিয়ে দেবেন। এতে কাস্টমার খুশি হবে যে তিনি জিতেছেন, আর আপনিও আপনার আসল দামে বিক্রি করতে পারলেন।
৫. আত্মীয় এবং ফ্রি-স্যাম্পল কালচার
নতুন ব্যবসায় আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুরা অনেক সময় ফ্রি বা কেনা দামে পণ্য চায়। এটা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। তাদের বুঝিয়ে বলুন, "এটা আমার ব্যবসা, শখের কাজ নয়। কাঁচামাল আমাকে টাকা দিয়ে কিনতে হয়।"
যদি ডিসকাউন্ট দিতেই হয়, তবে ১০% দিন, কিন্তু ফ্রি দেবেন না। যে আপনার ব্যবসার মূল্য বোঝে না, সে আপনার আসল কাস্টমার নয়।
৬. প্রিমিয়াম বনাম সস্তা: আপনি কোন পথে?
হ্যান্ডিক্রাফটস কখনো সস্তা পণ্য হতে পারে না। এটি মেশিনে তৈরি প্লাস্টিকের পুতুল নয় যে চাইলেই হাজার পিস বের হবে। আপনি যদি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি মেইনটেইন করেন, তবে দামও প্রিমিয়াম রাখুন।
কাস্টমারকে আপনার গল্পের কথা বলুন। এই শাড়িটি বুনতে কত রাত জেগেছেন, বা এই ফেসপ্যাকের উপাদানগুলো কত দূর থেকে সংগ্রহ করেছেন—সেটা কন্টেন্টে তুলে ধরুন। মানুষ পণ্যের চেয়ে গল্প বেশি কেনে।
উপসংহার: আত্মবিশ্বাসই আসল পুঁজি
নিজের কাজের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনি যদি জানেন আপনার প্রোডাক্ট সেরা, তবে সঠিক দাম চাইতে গলা কাঁপবে না। মনে রাখবেন, কম দামে খারাপ জিনিস বিক্রির চেয়ে, সঠিক দামে ভালো জিনিস বিক্রি করা অনেক সম্মানের এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসার লক্ষণ। সঠিক প্রাইসিং-ই পারে আপনার শখের কাজকে একটি সফল ব্র্যান্ডে পরিণত করতে।
আপনার পণ্যের মান বজায় রাখুন, সঠিক হিসাব করুন এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যান। সাফল্য আসবেই!