https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

বাংলাদেশে অনলাইনে ব্যবসার আসল খরচ: যে গোপন খরচের ফাঁদে আপনি পা দিচ্ছেন (হিসেব মিলিয়ে নিন)

top-news
  • 01 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

বাংলাদেশে ই-কমার্স বা এফ-কমার্স (ফেইসবুক কমার্স) এখন আর কেবল ট্রেন্ড নয়, বরং এটি একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। "চাকরি করব না, উদ্যোক্তা হব"—এই মানসিকতা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী অনলাইনে পেজ খুলছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটি খুবই লাভজনক মনে হয়। একটা ফেইসবুক পেজ খুললাম, চকচক বাজার বা জিঞ্জিরা থেকে কিছু প্রোডাক্ট সোর্সিং করলাম, আর বুস্ট করে দিলাম—ব্যাস, টাকা আর টাকা!

কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই এত সহজ? উত্তর হলো—না। অধিকাংশ নতুন উদ্যোক্তা প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। এর প্রধান কারণ হলো "Hidden Costs" বা গোপন খরচ সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমরা সাধারণত প্রোডাক্টের কেনা দাম, বুস্টিং খরচ আর ডেলিভারি চার্জ—এই তিনটি বিষয় মাথায় রাখি। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু খরচ আছে যা উইপোকার মতো আপনার ব্যবসার লাভ খেয়ে ফেলে। আজ আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন সব গোপন খরচের ব্যবচ্ছেদ করব, যা আপনি সম্ভবত হিসেবের খাতায় লিখছেন না।

১. রিটার্ন বা ফেরত আসা পার্সেলের ভুতুড়ে খরচ (The RTO Nightmare)

বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন হলো 'রিটার্ন'। আপনি কাস্টমারের কাছে প্রোডাক্ট পাঠালেন, কিন্তু কাস্টমার প্রোডাক্ট রিসিভ করলেন না। কারণ হতে পারে হাজারটা—"ভাইয়া আমি তো এখন ঢাকায় নেই", "টাকা ম্যানেজ হয়নি", কিংবা সিম্পলি ফোন না ধরা।

এখানেই আসল খেলা শুরু।
যখন একটি প্রোডাক্ট রিটার্ন আসে, তখন আপনাকে দুইবার ডেলিভারি চার্জ গুনতে হয় (পাঠানো + ফেরত আনা)। ধরুন, ঢাকার বাইরে ডেলিভারি চার্জ ১৫০ টাকা। প্রোডাক্টটি ফেরত আসলে কুরিয়ার কোম্পানি আপনার থেকে ১৫০ টাকা (বা ক্ষেত্রবিশেষে রিটার্ন চার্জসহ ২০০ টাকা) কেটে রাখবে।

বাস্তব উদাহরণ:
আপনি ৫০০ টাকা লাভের আশায় একটি ড্রেস পাঠালেন। কাস্টমার সেটি রিসিভ করল না। আপনার লস হলো ১৫০ টাকা (কুরিয়ার চার্জ) + প্যাকিং মেটেরিয়াল খরচ ৩০ টাকা + আপনার শ্রম। অর্থাৎ, একটি রিটার্ন আপনার অন্য দুটি সফল অর্ডারের লাভ খেয়ে ফেলতে পারে। বাংলাদেশে অ্যাভারেজ রিটার্ন রেট ২০-২৫%, যা নতুনদের জন্য ভয়াবহ।

২. প্যাকেজিং এবং ব্র্যান্ডিংয়ের অদৃশ্য খরচ

শুরুতে আমরা ভাবি, একটা পলিথিনে মুড়িয়ে দিলেই তো হলো! কিন্তু এখনকার কাস্টমাররা অনেক সচেতন। তারা 'আনবক্সিং এক্সপেরিয়েন্স' চায়। দারাজ বা ভালো ব্র্যান্ডগুলোর প্যাকেজিং দেখে কাস্টমারদের এক্সপেক্টেশন অনেক বেড়ে গেছে।

  • বাবল র‍্যাপ (Bubble Wrap): প্রোডাক্ট যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য প্রচুর বাবল র‍্যাপ লাগে। এক রোল বাবল র‍্যাপের দাম ৫০০-১২০০ টাকা, যা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

  • কাস্টমাইজড বক্স: সাধারণ কার্টন বক্স দেখতে সস্তা লাগে। আপনি যদি নিজের লোগোসহ বক্স বানাতে চান, মিনিমাম ১০০০ পিস অর্ডার করতে হবে, যার একেকটির দাম ১৫-৪০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

  • টেপ এবং লেবেল: বিশ্বাস করুন, প্যাকিং টেপ এবং প্রিন্টেড ইনভয়েস বা লেবেলের খরচ মাসের শেষে হিসেব করলে চোখ কপালে উঠবে।

এই ছোট ছোট খরচগুলো প্রতি অর্ডারে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত যোগ করে, যা আপনি প্রোডাক্টের প্রাইসিং করার সময় হয়তো ধরেননি।

৩. পেমেন্ট গেটওয়ে এবং ক্যাশ-আউট চার্জ

বাংলাদেশে এখনো ৯০% লেনদেন হয় 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' (COD)-তে। কুরিয়ার কোম্পানিগুলো টাকা কালেকশন করে আপনাকে পেমেন্ট দেয়। কিন্তু এখানেও খরচ আছে:

  • COD Charge: অনেক কুরিয়ার কোম্পানি সংগৃহীত টাকার ওপর ১% বা তার বেশি 'ক্যাশ হ্যান্ডলিং চার্জ' বা COD চার্জ কাটে। অর্থাৎ ১০০০ টাকার প্রোডাক্টে ১০ টাকা তারা রেখে দেবে।

  • মোবাইল ব্যাংকিং খরচ: কাস্টমার যদি আপনাকে বিকাশ বা নগদে পেমেন্ট করে, আপনি যখন সেই টাকা এজেন্ট থেকে ক্যাশ-আউট করতে যাবেন, তখন হাজারে ১৮.৫০ টাকা বা তার বেশি খরচ হবে। আপনি যদি মার্চেন্ট একাউন্ট ব্যবহার করেন, সেখানেও ট্রানজেকশন ফি আছে।

মাস শেষে দেখবেন, হাজার হাজার টাকা শুধু টাকা বের করতেই চলে গেছে।

৪. কন্টেন্ট ক্রিয়েশন এবং ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন

চাইনিজ সাইট থেকে ছবি ডাউনলোড করে ব্যবসা করার দিন শেষ। এখন কাস্টমাররা 'অরিজিনাল ছবি' এবং 'ভিডিও রিভিউ' দেখতে চায়।

  • ফটোগ্রাফি: ভালো মানের ছবি তুলতে গেলে ডিএসএলআর বা ভালো মানের ফোনের পাশাপাশি লাইটবক্স, রিং লাইট, এবং নান্দনিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা প্রপস (ফুলদানি, কার্পেট) লাগে।

  • মডেল বা ইনফ্লুয়েন্সার: আপনি যদি শাড়ি বা পোশাকের ব্যবসা করেন, তবে মডেল ছাড়া প্রোডাক্ট সেল করা কঠিন। একজন মডেলকে দিয়ে ফটোশুট করানো বা ছোটখাটো ইনফ্লুয়েন্সারকে দিয়ে রিভিউ করানোর খরচ আছে। অনেক সময় তাদের 'পিআর প্যাকেজ' (ফ্রি গিফট) পাঠাতে হয়, যার খরচ পুরোটাই আপনার পকেট থেকে যায়।

৫. নষ্ট বা ড্যামেজ প্রোডাক্ট (Inventory Shrinkage)

অনলাইন ব্যবসায় প্রোডাক্ট নষ্ট হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

  • কুরিয়ারের অবহেলা: কুরিয়ারের গাড়িতে বা হাব-এ প্রোডাক্ট চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া, কাঁচের জিনিস ভেঙে যাওয়া, লিকুইড প্রোডাক্ট লিক করা—এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা। কুরিয়ার কোম্পানি খুব কম সময়ই এর ক্ষতিপূরণ দেয়।

  • আবহাওয়া: বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় অনেকদিন স্টকে থাকা পোশাক ফাঙ্গাস পড়ে নষ্ট হতে পারে, লেদারের পণ্য চামড়া উঠে যেতে পারে।

  • ডেড স্টক (Dead Stock): আপনি হয়তো শীতের জন্য ১০০ পিস হুডি এনেছিলেন। ৭০ পিস বিক্রি হলো, ৩০ পিস রয়ে গেল। গরম পড়ে যাওয়ায় এই ৩০ পিস আর বিক্রি হবে না। এই আটকে থাকা টাকাটা (Capital Lock) ব্যবসার জন্য বড় ক্ষতি। এই খরচটা আমরা প্রায়ই এড়িয়ে যাই।

৬. কমিউনিকেশন এবং কাস্টমার সাপোর্ট কস্ট

"ইনবক্স চেক করুন"—এই কালচার মেইনটেইন করতেও খরচ আছে।

  • ফোন বিল: কাস্টমারকে কনফার্মেশনের জন্য কল করা, কুরিয়ারের সাথে ঝগড়া করা (প্রোডাক্ট কেন ডেলিভারি হলো না)—এতে প্রচুর মোবাইল ব্যালেন্স খরচ হয়।

  • এসএমএস (SMS) ইন্টিগ্রেশন: বাল্ক এসএমএস বা অটোমেটেড কনফার্মেশন মেসেজ পাঠাতে সফটওয়্যার সাবস্ক্রিপশন ফি লাগে।

  • সময়ের মূল্য (Opportunity Cost): আপনি নিজে যদি সারাদিন চ্যাটিং আর কমেন্টের রিপ্লাই দেন, তবে ব্যবসার গ্রোথ নিয়ে ভাববেন কখন? আর যদি মডারেটর রাখেন, তবে তার বেতন (মাসে ৫০০০-১০০০০ টাকা) একটি বড় ফিক্সড কস্ট।

৭. লিগ্যাল এবং প্রশাসনিক খরচ

অনেকে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা শুরু করেন, কিন্তু ব্যবসা বড় করতে হলে এটি মাস্ট।

  • ট্রেড লাইসেন্স: সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লাইসেন্স করতে এবং প্রতি বছর নবায়ন করতে ৫০০০-৮০০০ টাকা খরচ হতে পারে।

  • TIN এবং ভ্যাট: বর্তমানে ফেসবুকে বুস্ট করতে গেলে ভ্যাট দিতে হয়। ব্যাংকে ট্রানজেকশন বাড়লে ট্যাক্স ফাইলের ঝামেলা আছে। এগুলো মেইনটেইন করতে অনেক সময় প্রফেশনাল কনসালট্যান্টের দরকার হয়, যা একটি বাড়তি খরচ।

৮. টেকনোলজি এবং সফটওয়্যার

খাতায় লিখে অর্ডার ম্যানেজ করা একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সম্ভব। অর্ডার বাড়লে আপনাকে অটোমেশনের দিকে যেতেই হবে।

  • ওয়েবসাইট: ডোমেইন, হোস্টিং এবং ডেভেলপার খরচ। বছরে রিনিউয়াল ফি আছে।

  • অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার: ইনভেন্টরি এবং কুরিয়ার ট্র্যাকিং একসাথে করার জন্য বিভিন্ন দেশি সফটওয়্যার (SaaS) এখন সাবস্ক্রিপশন মডেলে কাজ করে। মাসে ৫০০-২০০০ টাকা এই খাতেও যায়।

৯. অদৃশ্য মানসিক চাপ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি

টাকা দিয়ে মাপা না গেলেও, এটি উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় খরচ। বাংলাদেশে ই-কমার্স মানে ২৪/৭ ডিউটি। রাত ২টায় কাস্টমার মেসেজ দেবে, সকাল ৭টায় কুরিয়ার ওয়ালা ফোন দেবে। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, চোখের সমস্যা, এবং সারাক্ষণ টেনশনে থাকা—এই 'হেলথ কস্ট' বা স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক উদ্যোক্তাকে দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ করে ফেলে।

উপসংহার: বাঁচার উপায় কী?

এত খরচের কথা শুনে ভয় পাবেন না। ব্যবসার মূল মন্ত্র হলো সঠিক পরিকল্পনা। আপনি যখন প্রোডাক্টের দাম নির্ধারণ করবেন (Pricing Strategy), তখন কেবল কেনা দাম আর লাভ ধরবেন না। এই গোপন খরচগুলো কাভার করার জন্য একটি 'বাফার মার্জিন' (Buffer Margin) রাখতে হবে।

১. প্রোডাক্টের দাম নির্ধারণে অন্তত ২০% অপারেশনাল কস্ট ধরুন।
২. প্যাকেজিং খরচ কমানোর জন্য বাল্ক বা পাইকারি দরে কিনুন।
৩. রিটার্ন রেট কমানোর জন্য কনফার্মেশন কল এবং অ্যাডভান্স ডেলিভারি চার্জ নেওয়ার চেষ্টা করুন।
৪. প্রতিটি পয়সার হিসেব রাখার জন্য এক্সেল শিট বা সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।

মনে রাখবেন, বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে কেবল সস্তায় পণ্য বেচলেই হবে না, বরং স্মার্টলি খরচ ম্যানেজ করতে হবে। যে খরচগুলো চোখের আড়ালে থাকে, সেগুলোই দিনশেষে আপনার ব্যবসার ভাগ্য নির্ধারণ করে।

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *