বাংলাদেশে এখন ই-কমার্সের জোয়ার চলছে। দারাজ (Daraz), চালডাল (Chaldal) থেকে শুরু করে ফেসবুকে হাজারো এফ-কমার্স (F-commerce) পেজ। সবাই কিছু না কিছু বিক্রি করছেন। কিন্তু একটা কমন সমস্যা লক্ষ্য করেছেন কি? বেশিরভাগ সেলার সুন্দর একটা ছবি দেন, আর ক্যাপশনে লেখেন— “Price in Inbox” অথবা শুধু কপি-পেস্ট করা কিছু টেকনিক্যাল তথ্য।
সত্যি বলতে, এই ভুলটাই আপনার সেল কমিয়ে দিচ্ছে। কাস্টমার যখন কোনো প্রোডাক্ট অনলাইনে দেখে, সে সেটা ছুঁতে পারে না, গন্ধ নিতে পারে না বা গায়ে দিয়ে দেখতে পারে না। তার ভরসা শুধুমাত্র আপনার আপলোড করা ছবি এবং তার নিচে লেখা ঐ কয়েক লাইন কথা। ওই লেখাটাই আপনার দোকানের "সেলসম্যান"।
আপনি হয়তো ভাবছেন, "ভাই, আমি তো আর হুমায়ূন আহমেদ না, আমি এত গুছিয়ে লিখব কীভাবে?" বিশ্বাস করুন, প্রোডাক্ট ডেসক্রিপশন লেখার জন্য আপনাকে সাহিত্যিক হতে হবে না। শুধু কাস্টমারের মনের কথাটা বুঝতে হবে। চলুন, একদম গোড়া থেকে শিখি কীভাবে এমন ডেসক্রিপশন লিখবেন যা কাস্টমারকে "অর্ডার নাউ" বাটন চাপতে বাধ্য করবে।
১. আপনার কাস্টমার আসলে কে? (Know Your Audience)
সবার জন্য সব প্রোডাক্ট না। আপনি যদি লুঙ্গি বিক্রি করেন, আর সেখানে "কর্পোরেট জাঁকজমক" ঘরানার ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে হবে না। আবার আপনি যদি হাই-এন্ড গেমিং পিসি বিক্রি করেন, সেখানে "খুবই সস্তা ও মজবুত" লিখলে গেমাররা আগ্রহ পাবে না।
বাংলাদেশে কাস্টমার দুই ধরণের হয়:
১. আবেগী ক্রেতা: যারা শাড়ি, গয়না, ঘর সাজানোর জিনিস কেনেন। এদের সাথে কথা বলতে হবে ইমোশন দিয়ে।
২. যৌক্তিক ক্রেতা: যারা গ্যাজেট, বাইকের পার্টস বা ইলেকট্রনিক্স কেনেন। এরা চায় স্পেসিফিকেশন এবং ওয়ারেন্টি।
লেখার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি কার সাথে কথা বলছি? একজন ব্যস্ত গৃহিণী নাকি একজন ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র? তাদের ভাষায় কথা বলুন। "তুই-তোকারি" বা অতিরিক্ত "স্যার স্যার" না করে, মার্জিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ টোন ব্যবহার করুন।
২. ফিচারের গান গাইবেন না, বেনিফিট বিক্রি করুন (Feature vs. Benefit)
এটা হলো কপিরাইটিংয়ের স্বর্ণের নিয়ম। সেলার হিসেবে আপনি জানেন আপনার প্রোডাক্টে কী আছে (Feature), কিন্তু কাস্টমার জানতে চায় এতে তার কী লাভ (Benefit)।
উদাহরণ দেখা যাক (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে):
ভুল অ্যাপ্রোচ (ফিচার): এই পাওয়ার ব্যাংকে 20,000 mAh ব্যাটারি এবং ফাস্ট চার্জিং সাপোর্ট আছে।
সঠিক অ্যাপ্রোচ (বেনিফিট): লোডশেডিংয়ের ঝামেলায় ফোনে চার্জ না থাকার ভয় আর নেই! এই পাওয়ার ব্যাংকটি দিয়ে আপনার ফোন ফুল চার্জ করতে পারবেন টানা ৪-৫ বার। ঢাকার জ্যামে বসে বা লম্বা ভ্রমণে—আপনার ফোন থাকবে সবসময় সচল।
দেখলেন পার্থক্যটা? প্রথমটা তথ্য, দ্বিতীয়টা সমাধান। মানুষ সমস্যার সমাধান কেনে, পণ্য নয়।
৩. শিরোনামেই বাজিমাত (Catchy Headline)
ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে মানুষ স্ক্রল করে ঝড়ের গতিতে। তাদের থামাবেন কীভাবে? আপনার প্রথম লাইন বা হেডলাইন হতে হবে হুকের মতো।
যেমন, আপনি যদি অর্গানিক মধু বিক্রি করেন।
বোরিং হেডলাইন: সুন্দরবনের খাঁটি মধু।
আকর্ষণীয় হেডলাইন: চিনির বিষাক্ততা থেকে পরিবারকে বাঁচাতে চান? নাস্তায় বা ওষুধে—ভরসা রাখুন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও খাঁটি মধুতে।
৪. গল্প দিয়ে কানেক্ট করুন (Storytelling)
বাঙালিরা গল্প শুনতে ভালোবাসে। জামদানি শাড়ি বিক্রি করছেন? শুধু সুতার কাউন্ট না লিখে একটু গল্প জুড়ে দিন।
“ভাবুন তো, কোনো এক পারিবারিক দাওয়াতে আপনি এই লাল জামদানিটা পরে ঢুকেছেন। সবাই আপনার শাড়ির প্রশংসা করছে। তাঁতীদের নিপুণ হাতে বোনা এই শাড়িটি শুধু পোশাক নয়, আমাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ।”
এই ছোট গল্পটা কাস্টমারকে কল্পনা করতে সাহায্য করে। সে নিজেকে ওই শাড়িতে দেখতে পায়। যখনই কাস্টমার কল্পনায় প্রোডাক্টটি ব্যবহার করা শুরু করে, তখন বিক্রি অর্ধেক হয়েই যায়।
৫. ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে তুলুন (Sensory Words)
অনলাইনে কাস্টমার যেহেতু প্রোডাক্ট ধরতে পারে না, তাই আপনার শব্দ দিয়ে তাদের অনুভূতি জাগাতে হবে। একে বলে Sensory Words।
খাবারের ক্ষেত্রে: মুচমুচে, জিভে জল আনা, ঘ্রাণযুক্ত, স্পাইসি।
কাপড়ের ক্ষেত্রে: মাখনের মতো নরম, আরামদায়ক, আভিজাত্যপূর্ণ।
গ্যাজেটের ক্ষেত্রে: সুপার ফাস্ট, স্মুথ, প্রিমিয়াম ফিনিশ।
উদাহরণ: “আমাদের এই ঘি-এর ঘ্রাণ আপনাকে ছোটবেলার নানুবাড়ির গরম ভাতের কথা মনে করিয়ে দেবে।”—এখানে ঘ্রাণ এবং স্মৃতি দুটোকেই টার্গেট করা হয়েছে।
৬. প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়ে দিন (Answer Objections)
কাস্টমারের মনে কেনাকাটার সময় কিছু ভয় কাজ করে।
এটা কি আসল?
রিটার্ন করা যাবে তো?
ডেলিভারি কত দিন লাগবে?
দামটা কি একটু বেশি হয়ে গেল?
আপনার ডেসক্রিপশনের শেষে এই ভয়গুলো দূর করুন।
লিখতে পারেন: “অর্ডার করতে ভয় পাচ্ছেন? আমাদের আছে ৭ দিনের ইজি রিটার্ন পলিসি। পছন্দ না হলে ফেরত, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই!” অথবা, “হয়তো ভাবছেন দামটা একটু বেশি? সস্তা কেমিকেলযুক্ত প্রোডাক্ট কিনে ত্বকের ক্ষতি করার চেয়ে, সামান্য বেশি দিয়ে জেনুইন প্রোডাক্ট কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
৭. মোবাইল ফ্রেন্ডলি ও স্ক্যানেবল ফরম্যাট
বাংলাদেশের ৮০% মানুষ মোবাইলে শপিং করে। মোবাইলের ছোট স্ক্রিনে বিশাল প্যারাগ্রাফ দেখলে কেউ পড়বে না।
ছোট ছোট বাক্য লিখুন।
বুলেট পয়েন্ট ব্যবহার করুন (যেমনটা আমি এখানে করছি)।
ইমোজি ব্যবহার করুন (ফেসবুকের জন্য), কিন্তু অতিরিক্ত নয়। ইমোজি লেখাকে জীবন্ত করে তোলে।
উদাহরণ ফরম্যাট:
🔥 [আকর্ষণীয় হেডলাইন]
👋 [সমস্যা ও সমাধানের গল্প]
✅ [প্রোডাক্টের মূল সুবিধা ১]
✅ [প্রোডাক্টের মূল সুবিধা ২]
✅ [প্রোডাক্টের মূল সুবিধা ৩]
🚚 [ডেলিভারি ও পেমেন্ট তথ্য]
📞 [অর্ডার করার নিয়ম/কল টু অ্যাকশন]
৮. এসইও (SEO) - গুগলে খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠি
আপনি যদি ওয়েবসাইটের জন্য লেখেন, তাহলে এসইও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ গুগলে যা লিখে সার্চ দেয়, সেই শব্দগুলো আপনার ডেসক্রিপশনে থাকতে হবে।
যেমন: আপনি যদি ‘Laptops’ বিক্রি করেন, তাহলে টাইটেল ও ডেসক্রিপশনে “Best Laptop price in Bangladesh,” “Laptop for students,” “Core i5 Laptop BD” এই শব্দগুলো (Keywords) কৌশলে ঢুকিয়ে দিন। তবে জোর করে শব্দ ঢোকাবেন না, ন্যাচারাল রাখুন।
৯. "Price in Inbox" কালচার থেকে বেরিয়ে আসুন
দয়া করে দাম লুকাবেন না। কাস্টমাররা এটা ঘৃণা করে। দাম লিখে দিলে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। যদি দাম ওঠানামা করে, তবে লিখুন "আজকের প্রাইস: ৫০০০ টাকা (পরিবর্তনযোগ্য)"। স্বচ্ছতা সেলের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
১০. কল টু অ্যাকশন (Call to Action - CTA)
সবকিছু সুন্দর করে লিখলেন, কিন্তু শেষে কাস্টমারকে কী করতে হবে সেটা বললেন না—তাহলে হবে না।
স্পষ্ট করে বলুন:
“স্টক খুবই সীমিত, আপনারটি বুঝে নিতে এখনই ‘Send Message’ বাটনে ক্লিক করুন।”
“অর্ডার করতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইটে: [লিংক]”
“বিস্তারিত জানতে কল করুন: [নম্বর]”
তাগাদা সৃষ্টি করুন (Create Urgency)। যেমন: "ঈদ অফার শুধুমাত্র আগামী ২ দিন!"
উপসংহার
ভালো প্রোডাক্ট ডেসক্রিপশন লেখা মানে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কথা বলা নয়। এর মানে হলো আপনার প্রোডাক্টের আসল গুণগুলো কাস্টমারের সামনে এমনভাবে তুলে ধরা, যাতে সে বুঝতে পারে এই জিনিসটাই তার প্রয়োজন। আপনি লেখক নন, আপনি একজন সমস্যা সমাধানকারী। আজ থেকেই আপনার পুরোনো পোস্টগুলো এডিট করুন, নতুন এই নিয়মগুলো অ্যাপ্লাই করুন। দেখবেন, শুধু লাইক-কমেন্ট না, হু হু করে সেলসও বাড়ছে।
শুভকামনা আপনার বিজনেসের জন্য!