কেবল লাজুকতা নয়, এটি একটি স্কিন কন্ডিশন
আমরা অনেকেই ছোটবেলায় শুনেছি, ফর্সা মানুষের গাল লাল হয়ে গেলে তাকে সুন্দর দেখায়। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন আপনি দেখেন আপনার নাকের দুপাশ, গাল বা কপাল সবসময় লাল হয়ে আছে এবং তার সাথে জ্বলুনি হচ্ছে, তখন সেটা আর সৌন্দর্যের প্রতীক থাকে না। এটি হয়ে দাঁড়ায় এক অসহ্য যন্ত্রণার নাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় 'রোজেশিয়া' (Rosacea)।
বাংলাদেশে রোজেশিয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা খুব কম। অধিকাংশ মানুষ এটিকে সাধারণ 'ব্রণ' বা 'একনি' মনে করে ভুল চিকিৎসা করেন। আবার অনেকে ভাবেন, গরমে এমন হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রোজেশিয়া এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ যা সঠিক সময়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আমাদের দেশের ভ্যাপসা গরম, ধুলোবালি এবং খাদ্যাভ্যাস এই সমস্যাকে আরও উসকে দেয়। আজ আমরা জানব রোজেশিয়া কেন হয়, কীভাবে বুঝবেন এবং এর প্রতিকার কী।
রোজেশিয়া আসলে কী?
রোজেশিয়া হলো ত্বকের এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত সমস্যা। এটি সাধারণত মুখের মধ্যভাগকে আক্রান্ত করে। অর্থাৎ নাক, গাল, কপাল এবং চিবুক লাল হয়ে যায়। অনেক সময় চামড়ার নিচে থাকা ছোট ছোট রক্তনালীগুলো ভেসে ওঠে। কখনো কখনো ব্রণের মতো ছোট ছোট দানা দেখা দেয়, যার ভেতরে পুঁজ থাকতে পারে। তবে মনে রাখবেন, এটি সাধারণ ব্রণের মতো নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোজেশিয়া কেন বাড়ছে?
আমাদের দেশে রোজেশিয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর পেছনে কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে যা আমাদের জীবনযাত্রার সাথে জড়িত:
১. স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার: এটি বাংলাদেশে রোজেশিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। ফর্সা হওয়ার জন্য বা মেছতা দূর করার জন্য অনেকেই ফার্মেসির দোকানদারের পরামর্শে মাসের পর মাস 'বেটনোভেট', 'পেভিসন' বা নামহীন বিভিন্ন 'ফর্সা হওয়ার ক্রিম' মুখে মাখেন। এগুলো সাময়িক ফর্সা ভাব আনলেও ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং চামড়া পাতলা করে ফেলে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় 'স্টেরয়েড ইনডিউসড রোজেশিয়া' (Steroid Induced Rosacea)।
২. আবহাওয়া: বাংলাদেশের তীব্র গরম এবং বাতাসের আর্দ্রতা (Humidity) রোজেশিয়ার জন্য যম। রোদের কড়া তাপ ত্বকের রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে দেয়, ফলে মুখ লাল হয়ে জ্বালাপোড়া করে।
৩. খাদ্যাভ্যাস: আমরা বাঙালিরা মশলাদার খাবার পছন্দ করি। কাচ্চি বিরিয়ানি, ফুচকা বা অতিরিক্ত ঝাল দেওয়া তরকারি খাওয়ার পরপরই অনেকের মুখ গরম হয়ে লাল হয়ে যায়। গরম চা বা কফিও এই ফ্লেয়ার-আপ (Flare-up) বা প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়।
রোজেশিয়ার লক্ষণসমূহ: কীভাবে বুঝবেন?
ব্রণ আর রোজেশিয়ার মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। নিচের লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখুন:
ফ্লাশিং (Flushing): হুট করেই মুখ কান লাল হয়ে গরম হয়ে যাওয়া। বিশেষ করে রাগের সময়, লজ্জায়, বা গরমের সংস্পর্শে।
স্থায়ী লালচে ভাব: সানবার্ন হলে যেমন লাল হয়, রোজেশিয়া হলে সেই লাল ভাব আর কমে না।
দৃশ্যমান রক্তনালী: নাকের পাশে বা গালে মাকড়সার জালের মতো সরু সরু লাল শিরা দেখা যাওয়া (Telangiectasia)।
জ্বালা-পোড়া: মুখে কোনো ক্রিম বা ফেসওয়াশ লাগালেই জ্বালা করা বা সুঁই ফোটানোর মতো অনুভূতি হওয়া।
চোখের সমস্যা: অনেকের ক্ষেত্রে চোখ লাল হয়ে থাকে, খচখচ করে বা চোখের পাতা ফুলে যায়। একে 'অকুলার রোজেশিয়া' বলে।
রোজেশিয়া রোগীর স্কিন কেয়ার রুটিন
রোজেশিয়া পুরোপুরি সারে না, তবে সঠিক যত্নে একে ১০০% নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এশিয়ান ত্বকের জন্য উপযোগী একটি রুটিন নিচে দেওয়া হলো:
ধাপ ১: জেন্টল ক্লিনজিং (পরিষ্কার করা)
ভুলে যান স্ক্রাবার বা দানাদার ফেসওয়াশ। রোজেশিয়া প্রবণ ত্বকে স্ক্রাবিং করা মানে আগুনে ঘি ঢালা। এমন ফেসওয়াশ ব্যবহার করুন যা 'সোপ-ফ্রি' এবং পিএইচ ব্যালেন্সড। মুখ ধোয়ার সময় জোরে ঘষবেন না। আলতো হাতে ফেসওয়াশ লাগিয়ে কুসুম গরম বা সাধারণ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। টাওয়াল দিয়ে ঘষে মুখ মুছবেন না, টিস্যু বা নরম কাপড় দিয়ে চেপে পানি শুকিয়ে নিন।
ধাপ ২: ময়েশ্চারাইজিং (আর্দ্রতা ধরে রাখা)
অনেকে ভাবেন মুখ তেলতেলে থাকলে ময়েশ্চারাইজার লাগবে না। এটি ভুল ধারণা। রোজেশিয়া ত্বকের 'স্কিন ব্যালিয়ার' বা সুরক্ষা স্তর দুর্বল থাকে। তাই এটি মেরামত করতে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার খুব জরুরি। এমন ময়েশ্চারাইজার বাছুন যাতে সিরামাইড (Ceramides), হায়ালুরোনিক অ্যাসিড বা গ্লিসারিন আছে। সুগন্ধিযুক্ত বা অ্যালকোহলযুক্ত লোশন ব্যবহার করবেন না।
ধাপ ৩: সান প্রোটেকশন (রোদ থেকে সুরক্ষা)
রোদের অতিবেগুনি রশ্মি রোজেশিয়ার ১ নম্বর শত্রু। মেঘলা দিনেও সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। তবে কেমিক্যাল সানস্ক্রিন অনেক সময় রোজেশিয়া ত্বকে জ্বালা ধরাতে পারে। তাই 'ফিজিক্যাল' বা 'মিনারেল' সানস্ক্রিন (যাতে জিংক অক্সাইড বা টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড আছে) ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদ। এটি ত্বকের ওপর একটা আস্তরণ তৈরি করে রোদকে রিফ্লেক্ট করে দেয়।
যেসব উপাদান খুঁজবেন (Ingredients to Look For)
স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কেনার সময় লেবেলে নিচের উপাদানগুলো খুঁজুন:
১. আজেলিক অ্যাসিড (Azelaic Acid): এটি রোজেশিয়ার জন্য মহৌষধ। এটি লালচে ভাব কমায়, প্রদাহ দূর করে এবং ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
২. নিয়াসিনামাইড (Niacinamide): এটি ত্বকের ব্যালিয়ার রিপেয়ার করে এবং লালচে ভাব কমাতে সাহায্য করে। তবে ৫% এর বেশি ঘনত্ব হলে জ্বালা করতে পারে।
৩. সেন্টেল্লা এশিয়াটিকা (Centella Asiatica/Cica): এশিয়ান স্কিন কেয়ারে এটি খুব জনপ্রিয়। 'থানকুনি পাতা'র নির্যাস দিয়ে তৈরি এই উপাদান ত্বককে ঠান্ডা রাখতে জাদুর মতো কাজ করে।
৪. অ্যালোভেরা ও গ্রিন টি: এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ত্বককে শান্ত রাখে।
যা যা পুরোপুরি এড়িয়ে চলবেন
গরম পানি: গোসলের সময় মুখে গরম পানি দেবেন না।
সুগন্ধি: পারফিউম বা স্ট্রং ফ্র্যাগন্যান্স যুক্ত ক্রিম।
অ্যালকোহল ও উইচ হেজেল: টোনারে এগুলো থাকলে তা ত্বককে আরও শুষ্ক করে দেয়।
মেনথল বা ইউক্যালিপ্টাস: এগুলো ঠান্ডা অনুভূতি দিলেও রোজেশিয়া ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
কেবল ক্রিম মেখে রোজেশিয়া কমানো যাবে না, ভেতর থেকেও সুস্থ হতে হবে।
ট্রিগার চিহ্নিত করুন: ডায়রিতে লিখে রাখুন কী খেলে বা কী করলে আপনার মুখ লাল হচ্ছে। সেটা এড়িয়ে চলুন।
রান্নাঘর সামলানো: আমাদের মা-বোনদের দীর্ঘক্ষণ চুলার পাড়ে থাকতে হয়। রান্নার সময় চুলার আঁচ কমিয়ে রাখুন বা মুখে বারবার ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিন।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: অতিরিক্ত মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে রোজেশিয়া বাড়িয়ে দেয়।
ডায়েট: শরীর ঠান্ডা রাখে এমন খাবার যেমন—শসা, টক দই, ডাবের পানি বেশি করে খান। অতিরিক্ত চিনি ও প্রসেসড ফুড বর্জন করুন।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
ঘরোয়া যত্নে যদি লাল ভাব না কমে বা নাকের আকৃতি পরিবর্তন হতে শুরু করে (রাইনোফাইমা), অথবা চোখে সমস্যা দেখা দেয়—তবে দেরি না করে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। ডাক্তার হয়তো আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক বা লেজার ট্রিটমেন্টের পরামর্শ দেবেন।
উপসংহার: ধৈর্যই সমাধান
রোজেশিয়া নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটি নিয়ন্ত্রনযোগ্য। আয়নায় নিজেকে দেখে মন খারাপ করবেন না। আপনার ত্বক অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সংবেদনশীল, তাই তার একটু বাড়তি আদর ও যত্ন প্রয়োজন। সঠিক পণ্য ব্যবহার এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে আপনিও পেতে পারেন সুস্থ ও প্রাণবন্ত ত্বক।
কোথায় পাবেন অরিজিনাল স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট?
রোজেশিয়া বা সেনসিটিভ স্কিনের জন্য প্রয়োজন শতভাগ অথেনটিক এবং ডার্মাটোলজিক্যালি টেস্টেড প্রোডাক্ট। নকল পণ্যের ভিড়ে সঠিক সমাধান খুঁজে পেতে ভরসা রাখুন TrustShopBD-এর ওপর। এখানে পাবেন CeraVe, The Ordinary, COSRX বা Cetaphil-এর মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের অরিজিনাল কালেকশন যা আপনার ত্বকের লালচে ভাব দূর করতে সাহায্য করবে।
ভিজিট করুন: www.trustshopbd.com – আপনার ত্বকের বিশ্বস্ত সঙ্গী।