ভবিষ্যতের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
আচ্ছা, মনে করে দেখুন তো ২০১৯ বা ২০২০ সালের কথা। তখন কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম যে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটা কম্পিউটার আমাদের হয়ে কবিতা লিখে দেবে, বা কোডিং করে দেবে? চ্যাটজিপিটি বা জেনারেটিভ এআই আসার পর বিশ্বটা যেন চোখের পলকে বদলে গেল। এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি ২০২৫-এর দোরগোড়ায়। প্রযুক্তি এখন আর কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভি না, এটা এখন আমাদের ঢাকার জ্যাম, গ্রামের কৃষি, আর অফিসের কাজের সাথে মিশে গেছে।
আজকের এই আড্ডায় (হ্যাঁ, এটাকে আর্টিকেল না ভেবে আড্ডাই ভাবুন) আমরা কথা বলব ২০২৫ সালের টেক ট্রেন্ডগুলো নিয়ে। এআই, অটোমেশন, রোবোটিক্স—এগুলো কি আসলেই ভয়ের কিছু, নাকি এগুলো ব্যবহার করেই আমরা "স্মার্ট বাংলাদেশ" গড়ব? এশিয়ার এই অংশে বসে আমরা কীভাবে এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাব, চলুন গভীরে গিয়ে দেখি।
১. এআই ২.০: চ্যাটবটের চেয়েও বেশি কিছু (Hyper-Personalized AI)
২০২৩-২৪ ছিল জেনারেটিভ এআই বা চ্যাটবটের যুগ। কিন্তু ২০২৫ হবে "এআই এজেন্টস"-এর যুগ। এর মানে কী? ধরুন, এখন আপনি চ্যাটজিপিটিকে বলছেন একটা মেইল লিখে দিতে। ২০২৫-এ আপনার পার্সোনাল এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট শুধু মেইল লিখবে না, বরং আপনার ক্যালেন্ডার চেক করে মিটিং সেট করবে, উবার কল করবে, এমনকি গ্রোসারি অর্ডারও করে দেবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
আমাদের দেশে এআই-এর সবচেয়ে বড় বিপ্লব হবে "ভাষার ব্যবহারে"। গুগলের মতো জায়ান্টরা বাংলার ওপর জোর দিচ্ছে। ২০২৫ সালে গ্রামের একজন কৃষক স্মার্টফোনে মুখে বলবেন, "আমার ধানের পাতায় হলুদ দাগ, এখন কী ওষুধ দেব?" আর এআই সাথে সাথে তার লোকাল ভাষায় সমাধান দেবে। ডাক্তার বা এক্সপার্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কল সেন্টারগুলোতে আর মানুষ থাকবে না বললেই চলে, সেখানে এআই এত নিখুঁত বাংলায় কথা বলবে যে আপনি বুঝতেই পারবেন না ওটা রোবট।
২. অটোমেশন এবং আমাদের গার্মেন্টস শিল্প (Industrial Automation)
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো গার্মেন্টস বা আরএমজি সেক্টর। এতদিন আমরা সস্তা শ্রমের জন্য বিশ্বে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু চীন এবং ভিয়েতনাম তাদের ফ্যাক্টরিগুলো রোবোটিক অটোমেশনে নিয়ে গেছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশেও এর বড় প্রভাব পড়বে।
চাকরি কি থাকবে?
এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। কাটিং, সেলাই এবং ফিনিশিং-এ অটোমেটেড মেশিনের ব্যবহার বাড়বে। এর মানে হলো, যারা শুধু কায়িক শ্রম দেন, তাদের চাকরির ঝুঁকি বাড়বে। কিন্তু উল্টো পিঠে, এই মেশিনগুলো চালানোর জন্য দক্ষ অপারেটরের চাহিদা বাড়বে। ২০২৫ সালে একজন গার্মেন্টস কর্মীকে শুধু সুঁই-সুতো জানলে হবে না, তাকে মেশিনের ডিসপ্লে রিড করাও জানতে হবে। এশিয়ান প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে এই বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠীকে 'রিস্কিল' (Reskill) করা।
৩. রোবোটিক্স: রেস্টুরেন্ট থেকে ধানের ক্ষেত
জাপান বা চীনে রোবট ওয়েটার বা ডেলিভারি রোবট এখন ডালভাত। বাংলাদেশে কি ২০২৫-এ আমরা এটা দেখব? হয়তো ঢাকার গুলশান বা বনানীর কিছু হাই-এন্ড রেস্টুরেন্টে "গিমিক" হিসেবে রোবট ওয়েটার দেখা যাবে। তবে বাংলাদেশে রোবোটিক্সের আসল বিপ্লব হবে কৃষিখাতে।
এগ্রিকালচারাল রোবোটিক্স:
আমাদের কৃষি জমি কমছে, মানুষও কৃষিকাজ ছাড়ছে। এখানে আসবে ড্রোন এবং ছোট রোবট। ২০২৫ সালে ধানে সার দেওয়া বা কীটনাশক স্প্রে করার জন্য ড্রোন টেকনোলজি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে। ইতোমধ্যে অনেক স্টার্টআপ (যেমন- ফসল বা কৃষি নিয়ে কাজ করা টেক কোম্পানি) ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। এটি খরচ কমাবে এবং ফলন বাড়াবে।
৪. সাইবার সিকিউরিটি: হ্যাকারদের নতুন টার্গেট
যত বেশি ডিজিটাল হবো, তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে। ২০২৫ সালে "ডেটা" হবে নতুন তেল, আর এই তেল চুরির জন্য হ্যাকাররা ওৎ পেতে থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা আমরা ভুলিনি। এখন সব ব্যাংকিং অ্যাপে, সব তথ্য ক্লাউডে।
এআই বনাম এআই:
মজার (এবং ভয়ের) ব্যাপার হলো, হ্যাকাররা এখন এআই ব্যবহার করে সাইবার অ্যাটাক করছে। তাই ২০২৫ সালে সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্টদের চাহিদাও হবে আকাশছোঁয়া। বাংলাদেশে ডেটা প্রটেকশন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা তখন অপশনাল কিছু থাকবে না, এটা হবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
৫. ফিনটেক এবং ক্যাশলেস সোসাইটি
বিকাশ, নগদ, বা রকেটের মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যে ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত। ২০২৫ সালে আমরা "এমবেডেড ফাইন্যান্স"-এর দিকে যাব। অর্থাৎ, আপনি ফেসবুকে একটা শার্ট পছন্দ করলেন, সেখান থেকেই এক ক্লিকে পেমেন্ট হয়ে যাবে, আলাদা অ্যাপে ঢোকার দরকার নেই।
এশিয়ায় কিউআর কোড (QR Code) বিপ্লব চলছে। রাস্তার পাশের ফুচকাওয়ালা থেকে শুরু করে রিকশাচালক—সবার কাছেই ডিজিটাল পেমেন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। কাগজের টাকার ব্যবহার ২০২৫-এ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।
৬. গ্রিন টেক এবং ইলেকট্রিক ভেহিকেল (EV Revolution)
ঢাকার দূষণ নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত। ২০২৫ সাল নাগাদ ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভি-র এক বিশাল পরিবর্তন দেখা যাবে। ইতোমধ্যে চায়নিজ ইভি কোম্পানিগুলো এশিয়ান মার্কেট দখল করছে। বাংলাদেশেও হাইব্রিড এবং ইলেকট্রিক গাড়ির চার্জিং স্টেশন বাড়বে। শুধু গাড়ি নয়, আমাদের ঐতিহ্যবাহী রিকশা এবং অটোরিকশাগুলো আরও উন্নত ব্যাটারি টেকনোলজিতে চলবে, যা পরিবেশের ক্ষতি কমাবে। সোলার প্যানেলের ব্যবহার বাসা-বাড়িতে আরও স্মার্ট হবে, যা সরাসরি স্মার্ট গ্রিডের সাথে যুক্ত থাকবে।
৭. এডুকেশন এবং ফিউচার অফ ওয়ার্ক (EdTech)
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসবে আমাদের শেখার ধরণে। ২০২৫ সালে ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডের জায়গা নেবে অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR)। বাচ্চারা ইতিহাসের ক্লাসে বই পড়ার বদলে ভিআর (VR) হেডসেট পরে সরাসরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য বা মহাস্থানগড় দেখতে পারবে।
ফ্রিল্যান্সিং এবং গিগ ইকোনমি:
বাংলাদেশি তরুণদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং এক বড় আয়ের উৎস। কিন্তু এআই আসার ফলে ডেটা এন্ট্রি বা সাধারণ গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ কমে যাবে। ২০২৫ সালে যারা প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং (Prompt Engineering), এআই ম্যানেজমেন্ট, বা জটিল কোডিং জানবে, রাজত্ব তাদেরই হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে।
উপসংহার: আমরা কি প্রস্তুত?
২০২৫ সাল কোনো জাদুর বছর নয়, এটা একটা প্রক্রিয়ার অংশ। প্রযুক্তির এই বিশাল ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সামনে দুটি পথ খোলা। এক, ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া; দুই, প্রযুক্তির সাথে নিজেকে আপগ্রেড করা।
এশিয়ার অন্যান্য দেশ—যেমন ভারত, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়া—প্রযুক্তিকে লুফে নিচ্ছে। আমাদেরও সেটাই করতে হবে। রোবট আমাদের কাজ কেড়ে নেবে না, বরং যে মানুষটি রোবট বা এআই চালাতে জানবে, সে-ই আপনার কাজ কেড়ে নেবে। তাই নিজেকে আপডেট রাখার এখনই সময়। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আগে আমাদের চিন্তাভাবনা স্মার্ট হতে হবে।
প্রযুক্তি মানুষের মঙ্গলের জন্য, তাকে ভিলেন বানানোর সুযোগ নেই। ২০২৫ হোক প্রযুক্তি এবং মানবিকতার এক দারুণ মেলবন্ধন।