https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরার আনন্দ: কেন ফিরে আসাকে মনে হয় এক নতুন জীবনের শুরু?

top-news
  • 28 Nov, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

চেনা জানালায় অচেনা আকাশ

আমরা কেন ঘুরতে যাই? যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে? নাকি নতুন কিছু দেখার নেশায়? উত্তরটা যাই হোক, ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত কিন্তু ল্যান্ডস্কেপ দেখা নয়, বরং ভ্রমণ শেষে নিজের বাড়ির চেনা দরজায় চাবি ঘোরানো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া..."। কিন্তু সেই দুই পা ফেলে বিশ্ব দেখার পর যখন আমরা আবার সেই ঘরেই ফিরে আসি, তখন ঘরটাকে আর আগের মতো মনে হয় না। মনে হয়, এই চার দেয়ালের প্রতিটি কোণ যেন নতুন করে শ্বাস নিচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই 'ঘরে ফেরা' বা 'Homecoming'-এর একটা আলাদা আবেগ আছে। আমরা যারা ঢাকায় বা বড় শহরে থাকি, জ্যাম, ধুলোবালি আর কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে কয়েক দিনের জন্য কক্সবাজার, সিলেট বা দেশের বাইরে পালাই। কিন্তু ফেরার পথে যখন বাসটা গাবতলী টার্মিনালে ঢোকে কিংবা প্লেনটা ঢাকার রানওয়ে স্পর্শ করে, তখন মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়—"যাক, বাঁচলাম! অবশেষে বাড়ি ফিরলাম।" আজকের এই আর্টিকেলে আমরা সেই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করব—কেন ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরাকে মনে হয় এক নতুন জীবনের শুরু?

১. নিজের বিছানা: পৃথিবীর সবচেয়ে আরামদায়ক স্থান

আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ফাইভ স্টার হোটেলে থাকতে পারেন, সেখানকার ম্যাট্রেস হতে পারে মেঘের মতো নরম। কিন্তু ভ্রমণের পর নিজের সেই পুরনো, হয়তো কিছুটা তোবড়ানো বালিশ আর চেনা বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার যে সুখ, তা কোটি টাকা দিয়েও কেনা সম্ভব নয়।

সায়েন্স বলে, অচেনা জায়গায় আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি ঘুমায় না, একে বলে 'ফার্স্ট নাইট এফেক্ট'। কিন্তু নিজের ঘরে মস্তিষ্ক জানে এখানে কোনো বিপদ নেই। তাই ট্যুর থেকে ফিরে প্রথম রাতের ঘুমটা হয় গভীর এবং প্রশান্তির। মনে হয় যেন শরীরের প্রতিটি কোষ নতুন করে চার্জ হচ্ছে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারে মশারি টাঙিয়ে, ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়ে কাঁথা গায়ে জড়ানোর যে আরাম, সেটা আসলে এক ধরণের থেরাপি। এই ঘুমটাই আপনাকে পরের দিন সকালে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার শক্তি দেয়।

২. ডাল-ভাত আর ভর্তার অমৃত স্বাদ

ট্যুরে গিয়ে আমরা কী না খাই! কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট, সি-ফুড প্লাটার, স্টেক কিংবা বিরিয়ানি। প্রথম দুই দিন ভালো লাগে। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকেই বাঙালি মন আনচান করতে থাকে একটু 'ভর্তা-ভাত' বা পাতলা ডালের জন্য।

ঘরে ফেরার পর যখন ডাইনিং টেবিলে মায়ের হাতে রান্না করা গরম ভাত, সাথে একটু আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর পাতলা মসুর ডাল থাকে—তখন মনে হয় অমৃত খাচ্ছি। এই যে বাইরের চাকচিক্যময় খাবার ছেড়ে নিজের মাটির খাবারে তৃপ্তি পাওয়া, এটাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা। এই তৃপ্তিটাই হলো 'রিসেট বাটন'। শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি ফিরে পায়, আর মন ফিরে পায় তার স্বস্তি। মনে হয়, জীবনটা আসলে এই ছোট ছোট সুখেই সুন্দর।

৩. অপরিচ্ছন্ন ঘর বনাম মনের পরিচ্ছন্নতা

অনেক সময় দীর্ঘ ট্রিপ থেকে ফিরে দেখি ঘরের টেবিলে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে, বারান্দার গাছগুলো একটু নেতিয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটা বিরক্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু এর একটা পজিটিভ দিকও আছে।

যখন আপনি হাতে ন্যাতা বা ঝাড়ু নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করেন, তখন আসলে আপনি কেবল ঘর পরিষ্কার করছেন না, আপনি নিজের মনকেও গুছিয়ে নিচ্ছেন। ট্রিপে জমানো হাজারো স্মৃতি, ছবি আর অভিজ্ঞতার ভিড়ে নিজের বর্তমানকে নতুন করে সাজানোর এই প্রক্রিয়াটা দারুণ। জাপানিজ সংস্কৃতিতে একে এক ধরণের ধ্যানে রূপান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা যখন ট্রিপ থেকে ফিরে ব্যাগ আনপ্যাক করি, ময়লা কাপড়গুলো লন্ড্রিতে দিই আর সুভ্যেনিরগুলো শোকেসে সাজাই—তখন আমাদের সাবকনশাস মাইন্ডে একটা সিগন্যাল যায়: "ছুটি শেষ, এবার নতুন করে সব শুরু করার পালা।"

৪. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: চেনা জিনিস নতুন রূপে

ভ্রমণ আমাদের চোখ খুলে দেয়। আপনি যখন পাহাড়ের বিশালতা বা সমুদ্রের গর্জন দেখে ফিরে আসেন, তখন অফিসের ছোটখাটো পলিটিক্স বা জ্যামের বিরক্তিকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। আগে যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনি খুব টেনশন করতেন, ট্যুর থেকে ফেরার পর মনে হয়—"আরে, জীবন তো একটাই! এত প্যারা নিয়ে কী হবে?"

এটাকেই বলে 'ফ্রেশ স্টার্ট এফেক্ট'। আপনি যখন কিছুদিন দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে থাকেন, তখন ফিরে এসে নিজের জীবনটাকে থার্ড পারসন বা তৃতীয় ব্যক্তির মতো দেখতে পারেন। হয়তো মনে হবে, "রুমের ফার্নিচারগুলো একটু সরালে কেমন হয়?" অথবা "কাল থেকে সকালে একটু হাঁটব।" এই ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোই একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

৫. সম্পর্কের নবায়ন: গল্পের ঝুলি খোলা

বাঙালি পরিবার মানেই আড্ডা। আপনি যখন ট্যুর থেকে ফেরেন, তখন আপনি একা ফেরেন না, সাথে নিয়ে আসেন এক ঝুলি গল্প। সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে পরিবারের সবার সাথে বসে সেই গল্পগুলো বলা—কোথায় কী দেখেছেন, কার সাথে পরিচয় হলো, কোন খাবারটা বিচ্ছিরি ছিল, আর কোনটা দারুণ।

বাবা-মা, ভাই-বোন বা জীবনসঙ্গীর সাথে এই গল্প করার মুহূর্তগুলো সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়। যারা বাড়িতে ছিলেন, তারা আপনার গল্পের মাধ্যমে মানসিকভাবে ঘুরে আসেন আপনার সাথে। আর আপনি যখন তাদের চোখে বিস্ময় আর আনন্দ দেখেন, তখন আপনার ভ্রমণের সার্থকতা পূর্ণতা পায়। উপহার বা সুভ্যেনির দেওয়া-নেওয়ার আনন্দ তো আছেই। একটা ছোট্ট চাবির রিং বা এক প্যাকেট আচার—এটাই বুঝিয়ে দেয় যে আপনি দূরে থাকলেও তাদের কথা ভোলেননি।

৬. প্রযুক্তির বাইরে এবং বাস্তবের মাটিতে

ট্যুরে আমরা প্রচুর ছবি তুলি, চেক-ইন দিই। কিন্তু ফিরে আসার পর সেই ভার্চুয়াল জগত থেকে বাস্তবে ল্যান্ড করাটা জরুরি। ট্যুর থেকে ফিরে আমরা বুঝতে পারি, সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক-কমেন্টের চেয়ে পাশের মানুষটার সাথে সরাসরি কথা বলাটা কতটা জরুরি।

বাড়ি ফেরার পর যখন ওয়াইফাই কানেক্ট হয়, তখন নোটিফিকেশনের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তখন আর ওগুলো চেক করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, ফোনটা দূরে রেখে নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকার আকাশটা দেখি। নিজের শহরের সেই চেনা কোলাহল, রিকশার টুংটাং শব্দ—সবকিছুকে তখন আর নয়েজ মনে হয় না, মনে হয় জীবনেরই সাউন্ডট্র্যাক।

৭. কাজ করার নতুন অনুপ্রেরণা

অনেকে বলেন 'পোস্ট-ভ্যাকেশন ব্লুজ' বা ছুটির পর কাজে ফেরার অনীহা কাজ করে। কিন্তু যদি আপনি পজিটিভলি চিন্তা করেন, তবে দেখবেন ব্যাটারি রিচার্জ করার পরই তো ফোন সবচেয়ে ভালো সার্ভিস দেয়। আপনিও তাই।

ট্যুর আপনাকে দৈনন্দিন ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্তি দিয়েছিলো বলেই আপনি এখন বুঝতে পারছেন কেন আপনি কাজটা করছেন। হয়তো নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় এসেছে পাহাড়ে বসে, যেটা এখন অফিসে প্রয়োগ করতে পারবেন। অথবা ব্যবসার নতুন কোনো প্ল্যান মাথায় এসেছে। ফিরে আসা মানেই হলো সেই আইডিয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ।

৮. কৃতজ্ঞতাবোধ বা গ্র্যাটিচিউড

সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা ঘরে ফেরা আমাদের দেয়, তা হলো কৃতজ্ঞতা। পৃথিবীর অনেক দেশে বা অনেক জায়গায় মানুষ কত কষ্টে আছে, বা কত ভিন্নভাবে জীবন যাপন করছে—তা দেখে আসার পর নিজের ছাদ, নিজের ফ্যান, নিজের বাথরুম—এগুলোর প্রতি একটা মায়া জন্মে। মনে হয়, "আলহামদুলিল্লাহ, আমি অনেক ভালো আছি।"

এই কৃতজ্ঞতাবোধ মানুষকে মানসিকভাবে শান্ত করে। আর শান্ত মনই তো নতুন শুরুর জন্য সবচেয়ে উর্বর জমি।

উপসংহার: ফেরার আনন্দেই ভ্রমণের সার্থকতা

কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, "ফিরে এসো চাকা..."। আমরাও বারবার ফিরে আসি। আমরা পালাই, আবার ফিরে আসি। কারণ, আমরা জানি, দিনশেষে আমাদের একটা 'বাড়ি' আছে। এমন একটা জায়গা যেখানে আমাদের কোনো জাজ করা হয় না, যেখানে আমরা আমাদের আসল রূপে থাকতে পারি।

ভ্রমণ আমাদের শেখায় পৃথিবীটা কত বড়, আর ঘরে ফেরা আমাদের শেখায় আমাদের পৃথিবীটা আসলে কোথায়। তাই পরের বার যখন ট্রিপ থেকে ফিরবেন, তখন মন খারাপ করবেন না। বরং দরজার তালাটা খোলার সময় ভাববেন, আপনি একটি বইয়ের পুরনো অধ্যায় শেষ করে নতুন একটি অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছেন। আর সেই অধ্যায়ের নাম—"নতুন উদ্যমে চেনা জীবন।"



https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *