https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

ইকো-টুরিজম বাংলাদেশ ২০২৫: প্রকৃতির যেসব গোপন রাজ্যে আপনার পা পড়েনি এখনো (লুকানো স্বর্গের খোঁজে)

top-news
  • 01 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

শহরের জ্যাম, অফিসের ডেডলাইন, আর ধুলোবালি মাখা বাতাসের ভিড়ে আমাদের ফুসফুস যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন মন চায় এমন কোথাও পালাতে যেখানে কেবল সবুজের রাজত্ব। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা পালাতে চাইলেও গন্তব্য সেই গদ বাঁধা—কক্সবাজারের ভিড় বা সাজেক ভ্যালির জ্যাম। অথচ, আমাদের এই বাংলাদেশেই এমন কিছু জায়গা লুকিয়ে আছে, যা সুইজারল্যান্ড বা ভিয়েতনামের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণের ধরণ পাল্টাচ্ছে। এখন মানুষ আর শুধু 'পিকনিক' করতে যায় না, মানুষ এখন 'হিলিং' বা মানসিক প্রশান্তির খোঁজে বের হয়। আর এখানেই চলে আসে "ইকো-টুরিজম"-এর ধারণা। ইকো-টুরিজম মানে কিন্তু কেবল জঙ্গলে যাওয়া নয়; এর মানে হলো প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে, লোকাল কমিউনিটিকে সম্মান জানিয়ে এবং প্লাস্টিকের বোতল না ফেলে ভ্রমণ করা।

আজ আপনাদের নিয়ে যাবো বাংলাদেশের এমন কিছু গোপন প্রাকৃতিক রাজ্যে, যেখানে গেলে মনে হবে—এই বাংলা আসলেই রূপসী। আসুন, চিনে নিই ২০২৫ সালের সেরা কিছু অফবিট ইকো-টুরিজম গন্তব্য।

১. আমিয়াখুম ও নাফাখুম: বাংলার আমাজন ও নায়াগ্রা

বান্দরবান মানেই নীলগিরি বা নীলাচল নয়। আসল বান্দরবান লুকিয়ে আছে থানচি উপজেলার গভীরে। যারা একটু ট্রেকিং পছন্দ করেন, তাদের জন্য স্বর্গ হলো আমিয়াখুম। ২০২৫ সালে এসেও এটি বাংলাদেশের অন্যতম দুর্গম এবং সুন্দর জলপ্রপাত।

অভিজ্ঞতা কেমন হবে?
থানচি থেকে বোটে করে রেমাক্রি, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাহাড়ি পথ। পথের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে যাবে যখন দেখবেন পাথরের বুক চিরে নেমে আসছে স্বচ্ছ জলধারা। আমিয়াখুমকে বলা হয় বাংলার আমাজন। চারপাশের নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, তাই ফেসবুকের নোটিফিকেশন আপনাকে বিরক্ত করবে না।

ইকো-টুরিজম টিপস:
এখানে রাতে থাকার জন্য আদিবাসী পাড়াগুলোই ভরসা। তাদের মাচাং ঘরে থাকার অভিজ্ঞতা ফাইভ-স্টার হোটেলকেও হার মানাবে। পাহাড়িদের রান্না করা জুম চালের ভাত, বাঁশ কোড়ল আর দেশি মুরগির স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। মনে রাখবেন, পাহাড়ে চিপসের প্যাকেট বা বোতল ফেলা পাপের সমান। যা নিয়ে যাবেন, তা ব্যাগে করে ফেরত আনবেন।

২. টাঙ্গুয়ার হাওর: জলের ওপর পূর্ণিমার কাব্য

সিলেট বা সুনামগঞ্জ বললেই চোখের সামনে ভাসে জাফলং। কিন্তু আপনি যদি প্রকৃত ইকো-টুরিজমের স্বাদ নিতে চান, তবে গন্তব্য হওয়া উচিত টাঙ্গুয়ার হাওর—তবে লোকালয় থেকে দূরে। বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওর সাগরের রূপ নেয়, আর শীতে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে।

২০২৫-এর নতুন ট্রেন্ড:
এখন টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রিমিয়াম হাউসবোটের ছড়াছড়ি। কিন্তু ইকো-টুরিজমের আসল মজা ছোট ডিঙি নৌকায়। হাওরের মাঝখানে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে না গিয়ে, ট্যাকেরঘাট বা নীলাদ্রি লেকের পেছনের অংশে ক্যাম্পিং করার মজাই আলাদা।

রাতে যখন নৌকার ছাদে শুয়ে থাকবেন, মাথার ওপর দেখবেন লাখো তারা। জেনারেটরের শব্দহীন নিস্তব্ধ হাওরে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আপনাকে এক জাদুকরী জগতে নিয়ে যাবে। স্থানীয় মাঝিদের কাছে হাওরের বাউল গান শোনা আত্মার খোরাক যোগাবে। তবে সাবধান, হাওরের পানিতে সাবান বা শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন না, এতে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের ক্ষতি হয়।

৩. নিঝুম দ্বীপ: হরিণের সাথে লুকোচুরি

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত নিঝুম দ্বীপ সত্যিই এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। নামেই যার সার্থকতা—'নিঝুম' বা নীরব। এখানে নেই কোনো যান্ত্রিক কোলাহল।

কেন যাবেন?
বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাইরে প্রাকৃতিকভাবে হরিণ দেখার সেরা জায়গা এটি। ভোরে বা গোধূলি লগনে ম্যানগ্রোভ বনের পাশ দিয়ে হাঁটলে দেখা মিলবে চিত্রা হরিণের পালের। এখানকার চৌধুরীর খাল দিয়ে যখন নৌকা বেয়ে যাবেন, দুপাশের শ্বাসমূল আর পাখির ডাক আপনাকে সুন্দরবনের ফিলিংস দেবে।

গোপন স্পট:
নিঝুম দ্বীপের মূল বিচের বাইরেও 'নামার বাজার' এর দিকে ভার্জিন বিচ আছে, যেখানে লাল কাঁকড়ারা রাজত্ব করে। এখানে তাবু টাঙিয়ে রাতে বারবিকিউ করার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। তবে ইকো-টুরিজমের শর্ত হলো—উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে হরিণ বা পাখিদের ভয় দেখানো যাবে না।

৪. রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য: সিলেটের গোপন জঙ্গল

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন। কিন্তু লাউয়াছড়ার মতো এখানে পর্যটকদের ভিড় নেই। যারা জঙ্গল ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং এবং বন্যপ্রাণী ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা।

কী দেখবেন?
এখানে বানর, হনুমান, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ এমনকি উল্লুকও দেখা যায়। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় নানা প্রজাতির পাখির ডাক এবং পাতার মর্মর শব্দ এক গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে। বনের ভেতরেই টিলা এবং ছড়া (ছোট নদী) আছে।

এখানে থাকার জন্য বন বিভাগের বাংলো আছে, তবে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যেতে হয়। এখানকার আদিবাসী টিপরা পল্লীতে ঘুরে তাদের জীবনযাত্রা দেখাও ইকো-টুরিজমের অংশ।

৫. মনপুরা দ্বীপ: যেখানে সূর্য হাসে, সাগর কাঁদে

ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ মনপুরা। মেঘনার বুকে জেগে থাকা এই দ্বীপটি এখনো অনেক পর্যটকের কাছেই অজানা। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো সাইক্লিং এবং ক্যাম্পিং।

অভিজ্ঞতা:
পুরো দ্বীপে রিকশা বা সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি নারিকেল গাছ, আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বিশাল নদী। মনপুরার 'দক্ষিণ সাকুচিয়া' বিচ থেকে সূর্যাস্ত দেখার দৃশ্য ভোলার মতো নয়। এখানকার দধি বা মহিষের দুধের দই বিখ্যাত। শীতকালে এখানে ক্যাম্পিং করা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। নদীর পাড়ে তাবু গেড়ে রাতে আগুনের পাশে বসে আড্ডা দেওয়া—এ যেন এক অন্য ভুবন।

৬. তিনাপ সাইতার: বিশালতার হুংকার

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাতগুলোর একটি। এটি নাফাখুমের চেয়েও বিশাল এবং এর ট্রেইলটি তুলনামূলক নতুন।

কেন এটি স্পেশাল?
তিনাপ সাইতারে যাওয়ার পথটিই একটি অ্যাডভেঞ্চার। পাইন্দু খালের পাশ দিয়ে হাঁটা, উঁচুনীচু পাহাড় ডিঙানো—শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা নেবে এই পথ। কিন্তু ঝর্ণার সামনে দাঁড়ালে যখন জলকণা আপনার মুখে এসে পড়বে, তখন সব কষ্ট সার্থক মনে হবে। এটি এখনো মাস-টুরিজমের কবলে পড়েনি, তাই এর আদিম সৌন্দর্য এখনো অটুট।

ইকো-টুরিজম মানেই দায়িত্বশীলতা

২০২৫ সালে এসে আমাদের ভ্রমণের মানসিকতা বদলাতে হবে। "টাকা দিয়েছি, যা খুশি করব"—এই মানসিকতা প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর।
১. প্লাস্টিক বর্জন: পাহাড়ে বা সমুদ্রে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল বা ওয়ান-টাইম প্লেট ফেলে আসবেন না। নিজের আবর্জনা নিজের ব্যাগে করে শহরে ফিরিয়ে আনুন।
২. শব্দদূষণ রোধ: জঙ্গলে বা পাহাড়ে উচ্চস্বরে সাউন্ডবক্স বাজাবেন না। এতে বন্যপ্রাণীদের জীবনচক্র ব্যাহত হয়।
৩. লোকাল কালচারকে সম্মান: আদিবাসীদের ছবি তোলার আগে অনুমতি নিন। তাদের সংস্কৃতি বা পোশাক নিয়ে উপহাস করবেন না।
৪. লোকাল অর্থনীতি: বড় বড় রিসোর্টে না থেকে লোকাল কটেজ বা হোমস্টে-তে থাকার চেষ্টা করুন। এতে স্থানীয়রা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।

উপসংহার

বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু এর প্রকৃতির ভাণ্ডার বিশাল। উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে সাগর, পূর্বে চা বাগান আর পশ্চিমে ম্যানগ্রোভ—কী নেই এই দেশে? ২০২৫ সাল হোক ইকো-টুরিজমের বছর। আমরা এমনভাবে ভ্রমণ করব যেন আমাদের পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই সেখানে না থাকে, আর স্মৃতি ছাড়া কিছুই আমরা সাথে না আনি।

আসুন, ব্যাগ গোছানো শুরু করি। তবে এবার গন্তব্য হোক কোনো এক অজানা ট্রেইল, কোনো এক নির্জন দ্বীপ। দেখা হবে প্রকৃতির কোলে!



https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *