ঢাকার জ্যাম, ধুলোবালি আর একটানা কাজের চাপে আমাদের জীবনটা মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগে, তাই না? সারা সপ্তাহ অফিস, সংসার আর বাচ্চার স্কুল সামলে আমরা যখন শুক্রবারের দেখা পাই, তখন মনটা চায় এমন কোথাও পালিয়ে যাই যেখানে গাড়ির হর্ন নেই, আছে শুধু পাখির ডাক আর নির্মল বাতাস। কিন্তু সমস্যা হলো, ঢাকার আশেপাশে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা বলতেই আমাদের মাথায় আসে সেই গত্বাঁধা কয়েকটা নাম—যেখানে গেলে ভিড়ের কারণে শান্তি তো দূরের কথা, উল্টো ক্লান্তি বেড়ে যায়।
আজ আপনাদের জন্য খুঁজে বের করেছি এমন ৭টি চমৎকার উইকেন্ড স্পট বা গেটওয়ে, যেগুলো ঢাকার খুব কাছেই, অথচ কিছুটা লোকচক্ষুর আড়ালে। এই জায়গাগুলো পরিবারের সাথে, বিশেষ করে বাচ্চা এবং বয়স্কদের নিয়ে সময় কাটানোর জন্য একদম পারফেক্ট। চলুন, এক নজরে দেখে নিই আমাদের এই সিক্রেট লিস্ট।
১. জিন্দা পার্ক (নারায়ণগঞ্জ): প্রকৃতির কোলে এক টুকরো সমাজ
নারায়ণগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জিন্দা পার্ক কোনো সাধারণ পার্ক নয়। এটি একটি ‘কমিউনিটি ভিলেজ’। এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এই পার্কটি সবুজে ঘেরা, শান্ত এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন।
কেন যাবেন?
জিন্দা পার্কের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর নীরবতা। মাটির তৈরি নান্দনিক ঘরবাড়ি, বিশাল দিঘি, দিঘির ওপর ভেসে থাকা কাঠের সাঁকো আর লাইব্রেরি—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করে এখানে। বাচ্চাদের খেলার জন্য বিশাল মাঠ রয়েছে। এখানকার ক্যান্টিনের খাবারও বেশ ঘরোয়া এবং সুস্বাদু।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে ৩০০ ফিট রাস্তা দিয়ে কাঞ্চন ব্রিজ পার হয়ে সহজেই জিন্দা পার্কে যাওয়া যায়। নিজস্ব গাড়ি থাকলে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মাত্র ৪০-৫০ মিনিটের পথ। বাসে যেতে চাইলে কুড়িল থেকে বিআরটিসি বাসে কাঞ্চন ব্রিজ, সেখান থেকে অটোরিকশায় পার্ক।
টিপস: দুপুরের খাবারটা পার্কের ভেতরেই সেরে নিতে পারেন, তবে আগে অর্ডার দিলে ভালো হয়।
২. জল ও জঙ্গলের কাব্য (পুবাইল): গ্রামীণ জীবনের স্বাদ
আপনি কি চান আপনার সন্তান জানুক গ্রাম বাংলা আসলে কেমন? তাহলে গাজীপুরের পুবাইলে অবস্থিত ‘জল ও জঙ্গলের কাব্য’ হতে পারে আপনার সেরা গন্তব্য। এটি কোনো ফাইভ-স্টার রিসোর্ট নয়, বরং বিলাসবহুলভাবে গ্রামীণ জীবনযাপনের এক আয়োজন।
কেন যাবেন?
বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি ঘর, বিলের ধারের বাতাস আর দেশি খাবারের আয়োজন—সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। পূর্ণিমার রাতে বিলের পানিতে চাঁদের আলো দেখার অভিজ্ঞতা এখানে অসাধারণ। এখানে ইলেকট্রিসিটির খুব একটা ব্যবহার নেই, হারিকেনের আলোয় সন্ধ্যা কাটানো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
খরচ ও সুবিধা:
এটি মূলত ডে-লং ট্যুরের জন্য বিখ্যাত। জনপ্রতি খরচ কিছুটা বেশি মনে হতে পারে (৩০০০-৪০০০ টাকা), তবে সকালের নাস্তা, দুপুরের ভুরিভোজ আর বিকেলের স্ন্যাকস—সবই এর অন্তর্ভুক্ত। খাবারগুলো একদম মাটির চুলায় রান্না করা দেশি স্বাদ।
৩. মহেরা জমিদার বাড়ি (টাঙ্গাইল): ইতিহাসের রাজকীয় সাক্ষী
ইতিহাস আর নান্দনিকতার মিশেল চাইলে টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়ি এক কথায় অনবদ্য। বর্তমানে এটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা চমৎকার, যা পরিবারের জন্য খুব জরুরি।
কেন যাবেন?
বিশাল এলাকা জুড়ে সাদা রঙের কারুকাজ করা পুরনো দালানগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে রাজাদের আমলে। এখানকার বাগানগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। বাচ্চারা এখানে নিরাপদে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। এছাড়া পাশেই আছে মিনি চিড়িয়াখানা।
যাতায়াত ও খাওয়া:
মহাখালী থেকে টাঙ্গাইলের বাসে উঠে নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজিতে জমিদার বাড়ি। দুপুরের খাবারের জন্য ভেতরে ক্যান্টিন আছে, তবে বাইরে হাইওয়ে ইন বা ভালো রেস্তোরাঁতেও খেতে পারেন। ফেরার পথে টাঙ্গাইলের চমচম কিনতে ভুলবেন না!
৪. নিকলী হাওর (কিশোরগঞ্জ): বাংলার রাতারগুল
সিলেটের রাতারগুল বা টাঙ্গুয়ার হাওর অনেক দূরে। কিন্তু ঢাকার কাছেই যদি হাওরের বিশাল জলরাশির মাঝখানে ভেসে বেড়াতে চান, তবে কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওর সেরা অপশন।
কেন যাবেন?
বর্ষাকালে নিকলী হাওর তার আসল রূপ ফিরে পায়, তবে শরৎ বা শীতেও এর সৌন্দর্য কম নয়। ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ভাড়া করে স্বচ্ছ জলের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়ানো, মাঝখানে জেগে ওঠা দ্বীপে নেমে কিছু সময় কাটানো—সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
কীভাবে যাবেন?
গোলাপবাগ বা সায়েদাবাদ থেকে বাসে কিশোরগঞ্জ শহর, সেখান থেকে সিএনজিতে নিকলী বেড়িবাঁধ। চাইলে একদিনেই ঘুরে আসা সম্ভব, তবে হাওরের বুকে রাত কাটানোর মজাই আলাদা। এখন অনেক ভালো মানের হোটেল হয়েছে সেখানে।
৫. বালিয়াটি জমিদার বাড়ি (মানিকগঞ্জ): স্তম্ভের জৌলুস
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় অবস্থিত বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং সংরক্ষিত জমিদার বাড়ি। এর বিশাল সব স্তম্ভ বা পিলারগুলো দেখলেই চোখ কপালে উঠবে।
কেন যাবেন?
ফটোশুট এবং ইতিহাস জানার জন্য এটি সেরা জায়গা। এর স্থাপত্যশৈলী গ্রিক এবং রোমান রীতির মিশ্রণ। সামনে বিশাল পুকুর আর শান বাঁধাই করা ঘাট। পরিবারের সবাই মিলে বিকেলে ঘাটে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য চমৎকার জায়গা।
যাতায়াত:
গাবতলী থেকে সাটুরিয়ার বাসে সরাসরি যাওয়া যায়। সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। এটি ডে-ট্রিপের জন্য আদর্শ।
৬. নুহাশ পল্লী (গাজীপুর): গল্পের জাদুকরের ডেরা
হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লী অনেকের কাছেই পরিচিত, কিন্তু তবুও এটি ফ্যামিলি পিকনিকের জন্য তালিকার ওপরের দিকেই থাকে। পিরুজালী গ্রামে অবস্থিত এই বাগানবাড়িটি যেন এক স্বপ্নের জগৎ।
কেন যাবেন?
‘বৃষ্টি বিলাস’, ‘ভূত বিলাস’ নামের কটেজগুলো, দিঘির মাঝখানে দ্বীপ, ঔষধি গাছের বাগান আর লিচু বাগান—সব মিলিয়ে এক মায়াবী পরিবেশ। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানটি সাহিত্যপ্রেমী পরিবারের জন্য তীর্থস্থানের মতো।
সতর্কতা: পিকনিক বা দলগতভাবে যাওয়ার জন্য আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা ভালো।
৭. পদ্মা রিসোর্ট (লৌহজং): নদীর বুকে ভাসমান জীবন
মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত এই রিসোর্টটি যারা নদী ভালোবাসেন তাদের জন্য। নদীর বুকে ছোট ছোট কটেজগুলো দেখতে ভারি সুন্দর।
কেন যাবেন?
বিকেলে নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখা, ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে গরম ভাত খাওয়া আর নৌকায় ঘুরে বেড়ানো—এই তিনে মিলে আপনার উইকেন্ড হয়ে উঠবে সার্থক। বর্ষায় এর চারপাশ পানিতে থৈ থৈ করে, মনে হয় যেন পানির ওপর ভাসছেন।
যাতায়াত:
ঢাকা থেকে মাওয়া ঘাট হয়ে খুব সহজেই এখানে যাওয়া যায়। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে সময় লাগবে মাত্র ১.৫ থেকে ২ ঘণ্টা।
উপসংহার:
পরিবার নিয়ে ঢাকার কাছেই এই জায়গাগুলো থেকে ঘুরে আসতে পারেন যেকোনো ছুটির দিনে। মনে রাখবেন, গন্তব্য যেখানেই হোক, আসল আনন্দ লুকিয়ে থাকে প্রিয়জনদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতে। তাই আর দেরি না করে আগামী সপ্তাহান্তের প্ল্যানটা আজই করে ফেলুন! পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব, তাই ঘুরতে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না।
হ্যাপি ট্রাভেলিং!