https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

ঢাকার জ্যাম আর ব্যস্ততার ভিড়ে 'স্লো লিভিং': নিজেকে হারিয়ে ফেলার আগে খুঁজে পাওয়ার শিল্প

top-news
  • 29 Nov, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

যান্ত্রিক শহরের শ্বাসরুদ্ধকর দৌড়

সকাল সাতটা। অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙল। চোখ ডলতে ডলতেই মনে পড়ে গেল অফিসের প্রেজেন্টেশন কিংবা ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্টের কথা। এক কাপ চা বা কফি গলায় ঢেলে কোনোমতে তৈরি হয়ে রাস্তায় নামলেন। আর রাস্তায় নামা মানেই যুদ্ধের শুরু। সিএনজি পাওয়া যাচ্ছে না, বাসে ওঠার জায়গা নেই, রিকশাওয়ালারা যেতে চাইছে না। আর যদি গাড়িতে থাকেন, তবে ফার্মগেট বা বিজয় সরণির জ্যামে বসে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা।

এই চিত্রটি ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মানুষের প্রতিদিনের গল্প। আমরা দৌড়াচ্ছি। কেন দৌড়াচ্ছি, কার পেছনে দৌড়াচ্ছি—সেটা ভাবার সময় আমাদের নেই। আমাদের জীবনটা হয়ে গেছে একটা চেকলিস্টের মতো—স্কুল, কলেজ, ভালো চাকরি, বিয়ে, ফ্ল্যাট কেনা, গাড়ি কেনা। এই ইঁদুর দৌড়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, জীবনটা শুধু কোনো গন্তব্যে পৌঁছানোর নাম নয়, রাস্তার ধারের দৃশ্যগুলো উপভোগ করার নামও জীবন।

এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্বে এবং এখন এশিয়ায়ও একটি নতুন দর্শন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে—তার নাম "স্লো লিভিং" (Slow Living)। কিন্তু ঢাকার মতো বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও ব্যস্ত শহরে কি আদৌ 'স্লো' হওয়া সম্ভব? উত্তর হলো—হ্যাঁ, সম্ভব। এবং মানসিক সুস্থতার জন্য এটি এখন বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তা। আসুন, আজ আড্ডার ছলে জেনে নিই কীভাবে এই পাগলপারা শহরের বুকে থেকেও নিজের জন্য এক টুকরো প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

'স্লো লিভিং' আসলে কী? (ভুল ধারণা বনাম বাস্তবতা)

অনেকে মনে করেন, স্লো লিভিং মানে কাজ না করে অলস বসে থাকা, কিংবা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে হিমালয়ে চলে যাওয়া। একদমই না।
স্লো লিভিং মানে কচ্ছপের গতিতে কাজ করা নয়। এর মানে হলো—আপনি যা করছেন, তা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে, তাড়াহুড়ো না করে এবং উপভোগ করে করা। এটি "অটো-াইলট" মোড থেকে বেরিয়ে এসে "ম্যানুয়াল" মোডে জীবন চালানোর নাম।

ধরুন, আপনি ভাত খাচ্ছেন। এক হাতে মোবাইল স্ক্রল করছেন, আরেক হাতে খাবার মুখে দিচ্ছেন। আপনি কি খাবারের স্বাদ পাচ্ছেন? না। স্লো লিভিং বলছে—মোবাইলটা রাখুন। ভাতের সাথে ডাল মাখানোর ঘ্রাণটা নিন, মুখে দিন, চিবিয়ে স্বাদ নিন। এই যে বর্তমান মুহূর্তের সাথে সংযোগ স্থাপন—এটাই স্লো লিভিং।

ঢাকা শহরে কেন আমাদের 'থামা' প্রয়োজন?

আমাদের মস্তিষ্ক মাল্টি-টাস্কিংয়ের জন্য তৈরি হয়নি, কিন্তু ঢাকা শহরের লাইফস্টাইল আমাদের সেটা করতে বাধ্য করে।
১. মানসিক ক্লান্তি (Burnout): সারাক্ষণ হর্নের শব্দ, ধুলোবালি আর মানুষের ভিড় আমাদের নার্ভ সিস্টেমকে সবসময় উত্তেজিত রাখে। দিনশেষে আমরা এতটাই ক্লান্ত থাকি যে পরিবারের সাথে হাসিমুখে কথা বলার শক্তিও পাই না।
২. তুলনার সংস্কৃতি (FOMO): সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের "পারফেক্ট" জীবন দেখে আমাদের মনে হয় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এই হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পেতে স্লো লিভিং জরুরি।
৩. শারীরিক সুস্থতা: তাড়াহুড়ো করে খাওয়া, কম ঘুম, আর সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা—এগুলো গ্যাস্ট্রিক, প্রেসার আর হৃদরোগের কারণ হচ্ছে।

ঢাকার বুকে স্লো লিভিং চর্চার ব্যবহারিক উপায়

এখন প্রশ্ন হলো, মতিঝিলের অফিসগামী ব্যাংকার বা বনানীর ব্যস্ত করপোরেট চাকুরিজীবী কীভাবে এটি প্র্যাকটিস করবেন? চলুন ধাপে ধাপে দেখি।

১. সকালটাকে নিজের করে নিন (The Morning Ritual)

অধিকাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নেন। নোটিফিকেশন, মেইল, নিউজফিড—দিন শুরুর আগেই অন্যের এজেন্ডা আপনার মাথায় ঢুকে যায়।
পরিবর্তন: ঘুম থেকে উঠে অন্তত প্রথম ৩০ মিনিট ফোন ধরবেন না।

  • এক গ্লাস পানি পান করুন।

  • বারান্দায় যান বা জানালার পাশে দাঁড়ান। ঢাকার আকাশ সবসময় নীল থাকে না ঠিকই, কিন্তু ভোরের আলোটা সবার জন্যই এক।

  • চা বা কফিটা বানানোর সময় তাড়াহুড়ো করবেন না। পানির ফোটা, চায়ের লিকারের রং ছড়ানো—সবকিছু খেয়াল করুন। এই ১০-১৫ মিনিট সময় আপনাকে সারাদিনের যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে।

২. জ্যামকে শত্রুর বদলে মিত্র ভাবুন (Mindful Commuting)

ঢাকার জ্যাম আমাদের জীবনের এক নির্মম সত্য। এটাকে গালি দিয়ে বা রাগ করে পরিবর্তন করা যাবে না। উল্টো আপনার কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) বাড়বে।
পরিবর্তন: জ্যামে বসে থাকার সময়টাকে "Me Time" হিসেবে দেখুন।

  • বাসে বা গাড়িতে বসে অহেতুক ফেসবুকে স্ক্রল না করে কানে হেডফোন লাগিয়ে কোনো পডকাস্ট শুনুন বা অডিওবুক শুনুন।

  • জানালার বাইরে তাকান। রিকশাওয়ালার ঘাম, ফুটপাতের হকার, রাস্তার ধারের গাছ—মানুষ দেখুন। বিরক্তি নিয়ে নয়, কৌতূহল নিয়ে দেখুন। এটাকে বলে 'People Watching'। এতে আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়বে এবং বিরক্তি কমবে।

  • বড় শ্বাস নিন (Deep Breathing)। জ্যামে বসে ১০টি বড় শ্বাস নিন এবং ছাড়ুন। এটি আপনার হার্ট রেট স্বাভাবিক রাখবে।

৩. কাজের ফাঁকে 'লজেন্স' বিরতি

টানা কাজ করবেন না। আমাদের মস্তিষ্ক ৯০ মিনিটের বেশি টানা ফোকাস করতে পারে না।
পরিবর্তন: অফিসের ডেস্কে বসেই মাঝে মাঝে ২ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ রাখুন। দুপুরের লাঞ্চটা ডেস্কে বসে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে করবেন না। ক্যান্টিনে যান বা সহকর্মীদের সাথে গল্প করতে করতে খান। কাজের ফাঁকে এক কাপ চা খেতে নিচে নামুন (টং এর দোকান কালচার কিন্তু স্লো লিভিংয়ের একটা বড় অংশ, যদি সেটা আড্ডার জন্য হয়, গসিপের জন্য নয়)।

৪. ডিজিটাল ডিটক্স এবং সন্ধ্যা

বাসায় ফেরার পর আমরা শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিই, কিন্তু মনটা পড়ে থাকে অফিসের মেইলে বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে।
পরিবর্তন: বাসায় ঢোকার পর একটা নির্দিষ্ট সময় (যেমন রাত ৯টা থেকে ১০টা) ফোন সম্পূর্ণ সাইলেন্ট বা অন্য রুমে রাখুন।

  • পরিবারের মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।

  • বাচ্চাদের সাথে খেলুন।

  • বই পড়ুন। কাগুজে বইয়ের গন্ধ এবং স্পর্শ মস্তিষ্কের উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।

৫. ছুটির দিনে 'কিছু না করা'র আনন্দ

ঢাকার মানুষ ছুটির দিনেও ব্যস্ত। হয় দাওয়াতে যেতে হবে, নয়তো শপিং মলে, অথবা রেস্টুরেন্টে লাইন দিয়ে খেতে হবে।
পরিবর্তন: মাসে অন্তত একটা শুক্রবার রাখুন যেদিন কোথাও যাবেন না।

  • দেরি করে ঘুম থেকে উঠুন।

  • বাজার করার তাড়া থাকলে অনলাইন গ্রোসারি শপ ব্যবহার করুন, ওই সময়টা বাঁচিয়ে নিজের যত্ন নিন।

  • ছাদ বাগান বা বারান্দা বাগান করুন। মাটির স্পর্শ, গাছের নতুন পাতা গজানো দেখা—এগুলো থেরাপির মতো কাজ করে। ঢাকার কংক্রিটের জঙ্গলে এক চিলতে সবুজ আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অক্সিজেন।

৬. খাদ্যাভ্যাসে ধীরস্থিরতা

ফাস্টফুড বা প্রসেসড ফুড আমাদের জীবনকেও 'ফাস্ট' করে দিচ্ছে।
পরিবর্তন: সপ্তাহে অন্তত কয়েকদিন বাসায় রান্না করা খাবার খান। ভর্তা, ডাল, ভাত—আমাদের দেশি খাবারগুলো তৈরি করতে যেমন সময় লাগে, খেতেও সময় নিয়ে খেতে হয়। রান্না করাটাও একটা মেডিটেশন। মশলা কষানো, সবজি কাটা—এগুলোতে মনোযোগ দিলে দুশ্চিন্তা কমে।

৭. 'না' বলতে শেখা

আমাদের কালচারে 'না' বলাটা খুব কঠিন। কেউ দাওয়াত দিল, যেতেই হবে। বস কাজ দিল, করতেই হবে।
পরিবর্তন: নিজের মানসিক শান্তির জন্য বিনয়ের সাথে 'না' বলতে শিখুন। সব দাওয়াতে যাওয়ার দরকার নেই, সব আড্ডায় উপস্থিত থাকার দরকার নেই। JOMO (Joy of Missing Out) বা 'মিস করার আনন্দ' উপভোগ করুন। সবাই যখন কোনো ট্রেন্ডিং রেস্টুরেন্টে চেক-ইন দিচ্ছে, তখন আপনি বাসায় খিচুড়ি রান্না করে বৃষ্টির শব্দ শুনছেন—এতেই আসল শান্তি।

৮. প্রকৃতি এবং সংযোগ

ঢাকা শহরে পার্ক বা লেক খুব কম। তবু যতটুকু আছে, তা ব্যবহার করুন। ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক বা দিয়াবাড়ির খোলামেলা জায়গায় মাসে একবার হলেও যান। জুতো খুলে ঘাসের ওপর হাঁটুন (Earthing)। এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

উপসংহার: জীবন কোনো রেস নয়

স্লো লিভিং মানে জীবন থেকে পিছিয়ে পড়া নয়, বরং জীবনের গভীরতা উপভোগ করা। ঢাকা শহর হয়তো কখনোই থামবে না, হর্নের শব্দ হয়তো কালকেই বন্ধ হবে না। কিন্তু আপনি আপনার মনের ভেতর একটা 'সাউন্ডপ্রুফ' দেয়াল তৈরি করতে পারেন। যেখানে আপনি ধীর, স্থির এবং শান্ত।

মনে রাখবেন, কবরে যাওয়ার আগে আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় নেই। তাই দৌড়ে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছানোর চেয়ে, যাত্রাপথটা উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আজ থেকেই একটু ব্রেক কষুন। এক কাপ চা নিন, বারান্দায় বসুন এবং নিজেকে বলুন—"এত তাড়ার কিছু নেই, আমি ঠিক আছি।"

জীবন সুন্দর, যদি আপনি সেটা দেখার জন্য একটু সময় নেন।


https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *