ফ্যাশন সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, একটা সাধারণ ড্রেসকে অসাধারণ করে তুলতে এক টুকরো সঠিক গয়ই যথেষ্ট। ০২৫ সাল আমরা পার করেছি মিনিমালিস্ট বা সাদামাটা ডিজাইনের ওপর দিয়ে। কিন্তু ২০২৬? ওহ, ২০২৬ হতে যাচ্ছে একেবারে আলাদা! ফ্যাশন বোদ্ধারা বলছেন, এই বছরটা হবে "বোল্ড, বিউটিফুল অ্যান্ড লাউড"। অর্থাৎ, গয়না এবার আর শুধু সাজের অনুষঙ্গ নয়, গয়না নিজেই হবে আপনার সাজের কেন্দ্রবিন্দু।
সামনে বিয়ে বা পার্টির মৌসুম, কিংবা অফিসের নিত্যদিনের সাজ—সবখানেই গয়নার ট্রেন্ডে আসছে আমূল পরিবর্তন। আপনি যদি গয়নাপ্রেমী হন এবং নিজেকে ট্রেন্ডি রাখতে চান, তবে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য বাইবেল হতে পারে। চলুন, একদম খুঁটিয়ে দেখে নিই ২০২৬ সালে আংটি, নেকলেস এবং অন্যান্য এক্সেসরিজের জগতে কী কী নতুন চমক অপেক্ষা করছে।
১. ধাতুর দাপট: সোনার দিন কি শেষ? সিলভারের পুনরুত্থান
এতদিন আমাদের দেশে গয়না মানেই ছিল সোনা। "সোনাই আসল সম্পদ"—এই ধারণা থেকে আমরা ২০২৫ সালে কিছুটা বেরিয়ে আসছি। আন্তর্জাতিক রানওয়ে এবং লোকাল ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারদের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, স্টার্লিং সিলভার বা রুপার গয়নার এক বিশাল প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
কেন এই পরিবর্তন?
প্রথমত, সোনার আকাশচুম্বী দাম। দ্বিতীয়ত, সিলভার বা হোয়াইট মেটালের একটা "কুল" এবং "আধুনিক" ভাইব আছে যা জেন-জি (Gen-Z) এবং মিলেনিয়ালদের খুব পছন্দ। ২০২৫ সালে আমরা দেখব ভারী স্কাল্পচারাল সিলভার গয়নার চল। লিকুইড মেটাল ডিজাইন (যেখানে মনে হয় ধাতু গলে গড়িয়ে পড়ছে) খুব জনপ্রিয় হবে।
তবে যারা সোনা ছাড়া কিছু ভাবতেই পারেন না, তাদের জন্যও সুখবর আছে। "মিক্সড মেটাল" বা সোনা ও রুপার সংমিশ্রণ এখন সুপার ট্রেন্ডি। অর্থাৎ, আপনি অনায়াসেই আপনার সোনার চেইনের সাথে রুপার দুল পরতে পারেন। আগে এটাকে "ফ্যাশন ডিজাস্টার" বলা হলেও, ২০২৬ সালে এটাই "ফ্যাশন স্টেটমেন্ট"।
২. আংটির ট্রেন্ড: আঙ্গুল যখন কথা বলে
২০২৫ সালে আংটি বা রিং-এর ক্ষেত্রে একটা কথাই খাটবে—"The Bigger, The Better"। সেই সরু, চিকন আংটির দিন আপাতত ছুটিতে।
ককটেল রিং (Cocktail Rings):
পার্টিতে এখন আর হাতে একগাদা চুড়ি না পরলেও চলবে, যদি আপনার আঙুলে থাকে একটা বিশাল সাইজের ককটেল রিং। বড় পাথর, অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার এবং উজ্জ্বল রঙের পাথরের আংটি এবার খুব চলবে। রুবি, পান্না বা স্যাফায়ারের মতো দামী পাথর তো আছেই, তার সাথে সেমি-প্রেশাস স্টোন যেমন—অ্যামিথিস্ট বা টোপাজ বসানো বড় আংটিগুলো খুব ইন।
পিঙ্কি রিং (Pinky Rings):
কড়ে আঙুলে আংটি পরার স্টাইলটা ফিরে এসেছে। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই একটা পাওয়ার স্টেটমেন্ট। সাধারণত সিগনেট স্টাইল বা নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা পিঙ্কি রিং ২০২৬ সালে খুব দেখা যাবে।
স্ট্যাকিং রিং:
এক আঙুলে একটা নয়, বরং ৩-৪টি আংটি পরার চল আগেও ছিল, এবার সেটা আরও জোরালো হবে। তবে এবার স্ট্যাকিং হবে টেক্সচারের খেলা। একটা মসৃণ, একটা খসখসে, একটা পাথর বসানো—এভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে পরটাই হবে স্টাইল।
৩. গলার সাজ: নেকলেসে লেয়ারিং বিপ্লব
গলায় কী পরবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ২০২৬ সাল বলছে—"সব পরুন!"। নেকলেস ট্রেন্ডে এবার লেয়ারিং বা একটার সাথে আরেকটা পরার কায়দাটাই মেইনস্ট্রিম।
লম্বা পেন্ডেন্ট (Long Pendants):
৭০-এর দশকের সেই বোহেমিয়ান লম্বা চেইনগুলো আবার ফিরে এসেছে। বুকের নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকা লম্বা চেইনের সাথে বড় লকেট বা পেন্ডেন্ট। এটি শাড়ি, কুর্তি বা ওয়েস্টার্ন টপ—সবকিছুর সাথেই মানিয়ে যায় এবং আপনাকে লম্বা দেখাতে সাহায্য করে।
চকার (Chokers) এর নতুন রূপ:
চকার বা গলার সাথে লেগে থাকা হারগুলো হারিয়ে যায়নি, তবে এর রূপ বদলেছে। এখন আর ভেলভেটের ফিতা নয়, বরং মেটাল বা ধাতব শক্ত চকার (Rigid Chokers) এবং তার সাথে বড় কোনো মোটিফ—যেমন ফুল বা বিমূর্ত কোনো ডিজাইন খুব জনপ্রিয় হবে।
মিক্সড চেইন:
চিকন চেইনের সাথে মোটা লিঙ্ক চেইন (Link Chain) একসাথে পরা। গলার কাছে একটা ছোট লকেট, তার নিচে একটু ভারী চেইন, তার নিচে আরও লম্বা কোনো হার—এই "গলার মেলা" সাজটাই এখন ট্রেন্ড।
৪. কানের দুল: স্টেটমেন্ট এবং স্কাল্পচারাল
কানের দুলের ক্ষেত্রে ২০২৬ সাল আমাদের শেখাবে কীভাবে সাহসের সাথে সাজতে হয়।
ওভারসাইজড হুপস (Oversized Hoops):
হুপস বা রিং দুল কখনো পুরোনো হয় না। তবে ২০২৬ সালে এর সাইজ হবে বিশাল। কাঁধ ছোঁয়া রিং দুল, যা মেটালের মোটা পাতে তৈরি—এমন দুলগুলোই রাজত্ব করবে।
মিসম্যাচড ইয়ারিং (Mismatched Earrings):
দুই কানে দুই রকম দুল? হ্যাঁ, ঠিক তাই। এক কানে হয়তো একটা লম্বা দুল, অন্য কানে একটা ছোট স্টাড। অথবা দুই কানে একই ডিজাইনের কিন্তু ভিন্ন রঙের দুল। এই অ্যাসিমেট্রি বা অসামঞ্জস্যই এখনকার আর্ট।
ইয়ার কাফ (Ear Cuffs):
কান না ফুঁড়িয়েও কানের সাজ। পুরো কানজুড়ে জড়িয়ে থাকা ড্রাগন, সাপ বা লতা-পাতার ডিজাইনের ইয়ার কাফগুলো তরুণীদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হবে। এটি আপনাকে একটা পাঙ্ক এবং একই সাথে রাজকীয় লুক দেয়।
৫. মুক্তা: নানি-দাদির সিন্দুক থেকে রানওয়েতে
মুক্তা বা পার্ল বললেই আমাদের চোখে ভাসে গোল, সাদা, এবং খুব ফরমাল কোনো গয়না। কিন্তু ২০২৬ সালের মুক্তা মোটেও বোরিং নয়।
বারোক পার্ল (Baroque Pearls):
এখন পারফেক্ট গোল মুক্তার চেয়ে এবড়ো-খেবড়ো বা অমসৃণ আকারের "বারোক পার্ল" বেশি জনপ্রিয়। কারণ এর প্রতিটি পিস ইউনিক। এই মুক্তাগুলো দিয়ে তৈরি নেকলেস বা দুল দেখতে খুব আর্টিস্টিক হয়।
মুক্তা ও মেটালের ফিউশন:
শুধু মুক্তার মালা না পরে, সোনার চেইনের মাঝে মাঝে মুক্তা বসানো, অথবা সিলভারের দুলের সাথে ঝোলানো মুক্তা—এই ফিউশনটা খুব চলছে। ছেলেরা যারা গয়না পরতে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যেও মুক্তার চেইন পরার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে (হ্যারি স্টাইলস ইফেক্ট!)।
৬. টেকসই বা সাস্টেইনেবল গয়না
মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা জানতে চায় তাদের গয়নাটা কোথা থেকে এসেছে।
ল্যাব-গ্রোন ডায়মন্ড (Lab-Grown Diamonds):
খনি থেকে তোলা হীরের বদলে ল্যাবে তৈরি হীরের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হবে ২০২৬ সালে। এগুলো আসল হীরের মতোই চকচকে এবং মজবুত, কিন্তু দাম অনেক কম এবং পরিবেশের ক্ষতি করে না। এনগেজমেন্ট রিং-এর ক্ষেত্রে এটি এখন এক নম্বর পছন্দ।
রিসাইকেলড গোল্ড ও সিলভার:
পুরানো গয়না গলিয়ে নতুন ডিজাইনে গয়না বানানো—এটা এখন শুধু সাশ্রয়ী নয়, বরং পরিবেশবান্ধব চয়েস হিসেবেও দেখা হচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলো এখন গর্ব করে বলে যে তাদের গয়না ১০০% রিসাইকেলড মেটাল দিয়ে তৈরি।
৭. এক্সেসরিজ: ব্রোচ এবং বডি চেইন
গয়না কি শুধু নাক-কান-গলায় সীমাবদ্ধ? একদম না।
ব্রোচের ফিরে আসা (Brooch Revival):
ব্রোচ বা কোট পিন এতদিন শুধু বয়স্কদের জিনিস মনে করা হতো। কিন্তু এখন এটি জ্যাকেট, শাড়ি, এমনকি হিজাবের সাথেও স্টাইল করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাণী বা পতঙ্গের আকৃতির (যেমন ড্রাগনফ্লাই, বিটল পোকা) বড় ব্রোচগুলো খুব ইন।
বডি চেইন ও কোমর বিছা:
শাড়ির সাথে কোমর বন্ধনী বা কোমর বিছা তো ছিলই, এখন ওয়েস্টার্ন ড্রেসের সাথে, এমনকি বিকিনি বা ক্রপ টপের সাথেও পেটের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সরু বডি চেইন খুব স্টাইলিশ মনে করা হচ্ছে।
৮. কালার ট্রেন্ড: রঙের খেলা
২০২৬ সালে গয়নায় রঙের ব্যবহার বাড়বে। পান্না (Green Emerald), নীল স্যাফায়ার এবং লাল রুবি—এই তিনটি রঙের পাথর সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে। এর পাশাপাশি "এনামেল" বা মিনাকরা গয়নার কদর বাড়ছে। সোনা বা রুপার ওপর রঙিন মিনাকরা কাজ গয়নাকে একটা পপ-আর্ট লুক দেয়, যা ক্যাজুয়াল আউটফিটের সাথে দারুণ মানায়।
৯. পুরুষদের গয়না: আর শুধু ঘড়ি নয়
পুরুষদের ফ্যাশনে গয়না এখন আর ট্যাবূ নয়। ২০২৬ সালে ছেলেদের হাতে ব্রেসলেট, গলায় মোটা চেইন এবং কানে ছোট হুপ বা স্টাড পরাটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য হবে। বিশেষ করে লেদার এবং মেটালের কম্বিনেশনে তৈরি ব্রেসলেটগুলো ছেলেদের খুব প্রিয় হবে।
উপসংহার: আপনার স্টাইল, আপনার নিয়ম
এত সব ট্রেন্ডের ভিড়ে হারিয়ে যাবেন না। মনে রাখবেন, ট্রেন্ড হলো গাইডলাইন, নিয়ম নয়। ২০২৬ সালের ফ্যাশনের মূল মন্ত্র হলো—"ব্যক্তিত্বের প্রকাশ"।
আপনার যদি ভারী গয়না ভালো না লাগে, তবে পরবেন না। যদি রুপা পছন্দ না হয়, সোনাই পরুন। তবে একটু এক্সপেরিমেন্ট করতে দোষ কী? হয়তো একটা স্টেটমেন্ট আংটি বা একটা লেয়ারড নেকলেস আপনার পুরো লুকটাই বদলে দিতে পারে।
বাজেট এবং রুচি অনুযায়ী নিজের কালেকশন আপডেট করুন। কারণ গয়না শুধু সাজগোজ নয়, এটি আপনার কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাসেরও প্রতীক। ২০২৬ সাল হোক আপনার ঝলমলে ও রঙিন।